অনুবাদ: দেবপ্রিয়া রায়, নক্ষত্র চ্যাটার্জি
‘পাইস হোটেল’ শব্দটার সাথে আমার পরিচয় কলকাতার সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে গবেষণার প্রস্তাব লিখতে গিয়ে। তার আগে ‘পাইস হোটেল’ বলতে আমি ‘ভাতের হোটেল’ই বুঝতাম; যেখানে মূলত ভাত পাওয়া যায়। কলকাতা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে থাকার দৌলতে প্রথমবার পাইস হোটেলে খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল কাজের সূত্রে; স্কুলজীবনে আমার বাড়ি কৃষ্ণনগরের কাছের কেভিপিওয়াই (কিশোর বৈজ্ঞানিক প্রোৎসাহন যোজনা) পরীক্ষাকেন্দ্র কলকাতায় হওয়ায়। এছাড়াও বিশেষ করে হাতে সময় কম থাকলে যখন বাবা আর আমার ফেরার টিকিট কাটা থাকত, কলকাতার পিসির বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা না রেখে বিকেলের বা সন্ধ্যের শিয়ালদহ-কৃষ্ণনগর লোকাল ধরার আগে কিছু একটু খেতেই পাইস হোটেলে ঢুঁ মারা। তাছাড়া, অন্যান্য কারণও ছিল: মফঃস্বলের চিকিৎসা ব্যবস্থায় না কুলালে ভালো হাসপাতালের খোঁজে আসতেই হত মহানগর; কখনও কখনও আরোও লম্বাযাত্রার সময়ে বিরতি নেওয়ার জন্যেও থাকা হত কলকাতায়। তবে রোজদিন এই হোটেলগুলিতে খাওয়া শুরু হল যখন আমি কলকাতা শহরে একা থাকতে শুরু করলাম, কলেজে পড়ার সময়ে।
আমার গবেষণার বিষয়ে অর্থাৎ খাদ্যসংস্কৃতি অধ্যয়নে (ফুড স্টাডিজ) খাবার, স্থান এবং পরিচয়ের ধারণা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত; আমার জীবনেও তার অন্যথা হয়নি। প্রথমে বিষয়টা একটু অদ্ভুতই লাগত; বাড়িতে যেসব খাবার খেতে অভ্যস্ত, সেই খাবার বাইরে থেকে খাচ্ছি কেন? আমার আদ্যপান্ত মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে বাইরের খাবার বিশেষ দিনের জন্যেই বরাদ্দ থাকত; অথবা বাইরের খাবার হল গিয়ে ‘ফাস্ট ফুড’, যা স্বাস্থ্যকর নয়, এবং যা কিনা আজকালকার ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য থেকে নৈতিকতা সমস্ত কিছুর অবক্ষয়ের জন্যেই দায়ী। অবশ্য পাইস হোটেলের খাবারকে ঘরোয়া বলেই ঠাহর হত। পরের দিকে বুঝেছিলাম বাড়ি থেকে দূরে থাকতে থাকতে দিনদুপুরে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, ডাল আলুভাজা, আর পাতিলেবু দিয়ে খাওয়ার দিবাস্বপ্ন দেখলে বা কলাপাতায় জমিয়ে মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার ইচ্ছে হলে, পাইস হোটেলের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই। তাই, আমার বন্ধুরা যখন কলেজের কাছের দোকানগুলোয় ফ্রায়েড রাইস, চাউমিন, মোমো, এগরোল, কচুরি, বিরিয়ানি ইত্যাদি খেত, আমি তখন অধীর অপেক্ষায় থাকতাম রবীন্দ্র সদন মেট্রো স্টেশনের চার নং গেটের কাছের হোটেলে মাছ-ভাত খাওয়ার জন্য।
ঘরের খাবারের প্রতি এই আকুতি দ্বিতীয়বারের জন্যে ফিরে আসে এক নতুন প্রবাসী-বাঙালি জীবনের অনুভূতির সাথে যখন এম এ পড়তে গেলাম বেনারস; কলাপাতায় মাছ ভাত খাওয়ার ইচ্ছে তাড়া করতো মামাবাড়ির স্মৃতি উস্কে দিয়ে। বিশেষ উপলক্ষে যেমন পুজো, ভাই ফোঁটা ইত্যাদিতে পরিবারের সবাই একসাথে হলে মামাবাড়ির দুপুরের খাবার পরিবেশন হত বাগান ঘেরা বাড়ির পেছনের উঠোন থেকে সদ্য কেটে আনা কলাপাতায়। এসবের অনেক পরে, খাবার আর তাকে ঘিরে বিভিন্ন অভ্যাস, প্রাত্যহিক রীতিনীতির উপর গবেষণার ইচ্ছে নিয়ে আমি ফিল্ডওয়ার্ক করতে ফিরে আসি পাইস হোটেলেই। খাদ্যাভ্যাস নিয়ে গবেষণা করার আগ্রহের পিছনে ছিল পাইস হোটেলের সাধারণ খাবার পরিবেশনার বিষয়টা জানার এক সুপ্ত ইচ্ছে যার প্রতি গবেষণায় তেমন নজর দেওয়া হয়নি, কিন্তু দেওয়া উচিৎ ছিল। একটু খতিয়ে দেখলে পাইস হোটেল আসলে রন্ধনশিল্পের ইতিহাস, জনসাধারণের খাদ্যাভ্যাস, বাঙালি খাবারের বাণিজ্যকরণ ইত্যাদির এক আধার; যা কিনা সমাজ, শহর, মানুষ আর তাদের খাদ্যাভাসের বিবৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে। আমি বুঝতে পারি এ আমার মফঃস্বলী অস্তিত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ; সে দায়ে পড়ে ‘ভাতের হোটেলে’ খাওয়া হোক বা পরবর্তীতে সেসব অভ্যাসের মানে বদলে যাওয়া।
তবে পাইস হোটেল আসলে কী? আমাদের চলতি বাংলায় ‘হোটেল’ হল এমন জায়গা যেখানে ‘ফুডিং এন্ড লজিং’ অর্থাৎ থাকার এবং খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। নামবিশেষ্যর সাথে ক্রিয়াপদ জুড়ে দেওয়াকে বাঙালির সাংস্কৃতিক নিজস্বতা বলা চলে; যেমন, ধরুন ‘ল্যাদ’ খাওয়া বা কুঁড়েমি লাগা (ল্যাদ শব্দটা বাংলা ভাষায় কীভাবে এলো তা জানা মুশকিল তবে ল্যাদের সাথে ‘খাচ্ছি’ জুড়ে ‘ল্যাদ খাচ্ছি’ চলতি ভাষায় বেশ প্রচলিত, ল্যাদ খাওয়ার আক্ষরিক মানে করলে দাঁড়ায় কুঁড়েমি খাচ্ছি)। হোটেলগুলোকে ব্রিটিশযুগে জনপ্রিয়তা পাওয়া সরাইখানার উত্তরসূরী বলা চলে। ‘পাইস’ ছিল ব্রিটিশ আমলের সর্বনিম্ন মুদ্রা, ‘পাইস’ শব্দটার উৎপত্তি খুব সম্ভবত ‘পয়সা’ শব্দ থেকে । দেবাশীষ চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করেন তৎকালীন সময়ে একবারের আহারের বাঁধা দাম ছিল একটাকার ১/১৬ অংশ অর্থাৎ কিনা প্রায় ৬ পয়সা, পাইস বলতে অবিভক্ত ভারতের মুদ্রা ‘আনা’কেও বোঝাত।
বাড়ি থেকে দূরে থাকা, কাজের সূত্রে আসা বা অন্যান্য কারণে বাইরে খেতে বাধ্য হওয়া মানুষকে কম পয়সায় রোজদিন ঘরোয়া খাবার পরিবেশনের উদ্দেশ্যে এইসব হোটেলের উদ্ভব হয় ১৯২০র দিকে। ঘরের বাইরে খেতে গিয়ে শুধু সস্তায় স্বাস্থ্যকরই নয়, জাতপাতের শুদ্ধির কথাও মাথায় রাখতে হত তখন। সারাদিনের ক্লান্তি মেটাতে রোজ খাওয়া যায় এমন সহজপাচ্য, সাধারন এবং টাটকা খাবারের চাহিদা ছিল। বাঙালির ‘পেট রোগা’ বা ‘পেট মরা’ হওয়ার চারিত্রিক দুর্নাম (নাকি সুনাম) আর হজমশক্তি কম হওয়ায় ডাইজিন, জেলুসিল গোছের অ্যান্টাসিডের প্রতি অতিভক্তির উপর ভিত্তি করে বদহজম-বুকজ্বালা বা অন্যান্য হজমের সমস্যা নিয়ে রসিকতার শেষ নেই। তাই কম তেলমশলা দিয়ে রাঁধা মরশুমি শাকসবজি আর মাছের ঝোল আজও পাইস হোটেলের মেন্যুতে অন্যতম জনপ্রিয় পদ। গুনের সাথে তাল মিলিয়ে হয় তাদের নামকরণ; যেমন কলেজস্ট্রীটের মহল হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁর ‘পাতলা ঝোল-ভাত’ অর্থাৎ মাছ আর সবজি দিয়ে বানানো ট্যালটেলে ঝোল বা নিউমার্কেট এলাকার সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমের ‘কবিরাজি ঝোল’ মানে কবিরাজের অর্থাৎ চিকিৎসকের নির্দেশনে বানানো ঝোল।
পাইস হোটেলে ঢুকলেই চোখে পড়বে চক দিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডে লেখা খাবারের তালিকা। মরশুমি শাকসবজি বা কাঁচামালের বদলাতে থাকা দামের ভিত্তিতে বদলে যেতে থাকে তালিকার পদ, আর দামও। পাইস হোটেল ব্যবস্থায় প্রতিটি পদের জন্য আলাদা করে দাম বাঁধা থাকে। এই খাবারের তালিকা যেন এক আশ্চর্য আলেখ্য যাতে সময়ের সাথে সাথে পাইস হোটেলের খাওয়ার বিভিন্ন বিধি ধরা থাকে। আজকাল বেশীরভাগ পাইস হোটেলের হেঁশেলে মুরগি ঢোকে, তবু এখনও ‘শুধু হাঁসের ডিম পাওয়া যায়’-এর গরিমা ধরে রেখেছে বেশ কিছু হোটেল। সেকালে অবশ্য কোনও পাইস হোটেলেই পেঁয়াজ, রসুন বা মুরগির চল ছিলনা হিন্দু হেঁশেলের নিয়ম মেনে।
Courtesy: Mohamushkil’s blog
হোটেলগুলো মূলত থাকে অফিস পাড়ায় যেমন কোর্ট, সরকারি অফিস, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছকাছি; বা সাম্প্রতিককালে কলকাতার সেক্টর ফাইভ আইটি পার্ক এলাকায়। বিভিন্ন পাইস হোটেলে খাওয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একটাই উপসংহার টেনেছি আমি, “সব ভাতের হোটেল পাইস হোটেল না, তবে সব পাইস হোটেলই ভাতের হোটেল”। সেক্টর ফাইভ এলাকার ভাতের হোটেলে মিল ব্যবস্থা চলে যেখানে পুরো খাবারের দামের ভিত্তিতে মূল্যতালিকা তৈরী হয়; পাইস হোটেলের মত পদ-ভিত্তিক দামের ব্যাপার থাকে না। গোড়ার দিকে হোটেলগুলোতে পেটচুক্তির একটা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল যাকে নদীয়ার আঞ্চলিক ভাষায় ‘পেট ঠিকা’ বা ‘পেট ফুরন’ ও বলা হত; অর্থাৎ পেটপুরে খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা। আমার মনে হয় ‘ফুরন’ শব্দের মানে হল শেষ করা, খানিকটা “যা খেতে পারবেন তা শেষ করবেন” এর মত। সম্ভবত এসব লেখার তলায় ছোট্ট করে “শর্তাবলী প্রযোজ্য” বা আরও ভালো “যতক্ষণ খাবার আছে ততক্ষণ” লেখা থাকা উচিৎ।
মুর্শিদাবাদের পাইস হোটেলের কথা লিখতে গিয়ে প্রকাশ দাস বিশ্বাস তাঁর প্রবন্ধে লেখেন পাইস ব্যবস্থার উৎপত্তি হয় আসলে কিছু ধান্দাবাজ ক্রেতাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে। এক সময় বেশকিছু হোটেলে ভাতের দাম নেওয়া হলেও তার সাথে তরকারি বা ঝোল সাধারণত বিনামূল্যেই দেওয়া হত। কিছু ক্রেতা এই ব্যবস্থার সুবিধে নিয়ে হোটেল মালিকদের ঠকাতে শুরু করেন; তাঁরা অনেকখানি ভাতের ফরমাশ দিতে থাকেন কারণ সাথে খাওয়ার মতো তরিতরকারি এমনিই বিনামূল্যে পাওয়া যাবে। এমন বেশকিছু খাইয়ে বা ভোজনরসিক মানুষের হোটেল মালিকদের ঠকিয়ে নেওয়ার গল্প শোনা যায়, আর তার ফলেই তৈরী হয় পাইস সিস্টেম। এই প্রসঙ্গে আমার মায়ের কলেজ-জীবনের দীঘা ঘুরতে যাওয়ার এক মজার ঘটনা মনে পড়ছে, যা মা আমাদের প্রায়শই বলেন। মা’দের সাথে যাওয়া ছেলেরা এক হোটেলে এমন ভাবেই খেতে লাগে যে হোটেলের মালিকের মাথায় হাত; শেষমেশ তিনি হাত জোর করে তাঁদের আরোও খেতে মানা করতে বাধ্য হন। মা এর মনে পড়ে যেহেতু সেখানে পেটপুরে যতক্ষণ ইচ্ছে খাওয়ার নিয়ম ছিল তাই কীভাবে বেশ কিছু ছেলে ডন বৈঠক করে বা অল্প ব্যায়ম করে পেটে আবার জায়গা তৈরীর চেষ্টা করেন যাতে তাঁরা আরেকবার ভাত-তরকারী খেতে পারেন। ব্যবসা বাঁচাতে এমন ধূর্ত ক্রেতাদের মোকাবিলা করতেই পাইস ব্যবস্থার শুরু যেখানে প্রত্যেকটি পদের আলাদা আলাদা দামের উল্লেখ থাকে।
এর মানে আবার অনেকটা এইরকমও যে কেউ চাইলে রোজদিনের সাধারণ খাবার খেতে পারেন, আবার ট্যাঁকে জোর বাড়লে যেমন ধরুন মাইনে পাওয়ার দিনে রোজকার সেই খাবারেই কয়েকটা পদ জুড়ে বেশ জমিয়ে খাওয়া হয়ে যেতে পারে। মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে গিয়ে বর্ধমান স্টেশনের কাছেই এমন এক হোটেলে মাত্র ২১ টাকাতে ভাত-ডাল-সব্জির মিল খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। এখন, যখন ভোপালে আছি তখন চারপাশে তেমন হোটেল না থাকায় বেশীরভাগ সময় হোস্টেলের মেসেই খেতে বাধ্য হই। কাজ বা পড়াশোনার সূত্রে শহরে আসা কিন্তু বাড়ি জন্যে মনকেমন করা ছেলেদের আশ্রয় দেওয়া মেসবাড়ি বা বোর্ডিং হাউস থেকেও বেশ কিছু পাইস হোটেলের উৎপত্তি হয়। এখন সেগুলোই আমার মতো বাড়ী ছেড়ে পেয়িং গেস্টে থাকা, রান্না না জানা, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, ভাতের জন্য সারাদিন খিটখিট করা ভেতো বাঙালির খাওয়ার ঠাঁই।
বাংলা সাহিত্যে মেসবাড়ি সম্পর্কে প্রচুর লেখালিখি রয়েছে। বাঙালি গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউসে থাকতেন, যেখানে কবি জীবনানন্দ দাশও পরে থাকতেন। এই বোর্ডিং হাউসটি পরবর্তীকালে কলেজ স্ট্রিট এলাকার বিখ্যাত পাইস হোটেল “মহল”-এ রূপান্তরিত হয়। দেশভাগের পর উত্তর কলকাতার অলিগলির মেসবাড়ি সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করে; মালিকরা থাকার ব্যবস্থা তুলে দিয়ে সাবেক রান্নাঘরটিকে একটি পাইস হোটেলে বদলে ফেলেন। পাইস হোটেলগুলির পরিবেশও বেশ সাধারণ; কাঠের চেয়ার এবং টেবিল পাতা পাইস হোটেলে অফিসের বা রাতের খাবারের সময় ক্রেতাদের ভিড়ের মাঝেও বেশ আত্মীয়তা আশা করা যায়। এখানে খেতে এলে প্রথমেই আপনাকে কলাপাতার থালা, পাতের কোনায় সামান্য নুন, একটুকরো লেবু আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে স্বাগত জানানো হবে। । এরপরেই একজন প্রখর স্মৃতিশক্তিধারী বেয়ারা আপনাকে সেদিনের খাবারের পদগুলি অদ্ভুত দ্রুততার সাথে বলে শোনাবেন, যা বেশ মজার ব্যাপার। । নিয়মিত ক্রেতা না হলে বলতেও হতে পারে, “দাদা, আরেকটিবার বলুন দয়া করে, আমি কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না”। খদ্দের অল্প বিভ্রান্ত হলে তাঁর জন্যে মাছ, মাংস, বা নিরামিষের বিশেষ পছন্দের পদ্গুলির পরামর্শও থাকবে। নিয়মিত খান এমন প্রিয় মানুষের জন্যে বাড়তি সুবিধে, মাছ বা মাংসের ভালো টুকরোটা তাঁদের জন্যেই সরানো থাকবে। যদি জানতে চান খাবার ভালো হবে কিনা, তবে শুনতে হতে পারে “আমাদের ফ্রিজ নাই” অর্থাৎ আগের দিনের অবশিষ্ট খাবার তাঁরা বাঁচিয়ে রাখেন না।
আজকাল আমার পাইস হোটেল যাওয়া হয় ফিল্ডওয়ার্কের জন্যেই। এমন দিনগুলোর জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। যদুনাথ ভবনে কাজ করার সময়, আমি রাসবিহারী মেট্রো স্টেশন থেকে ইচ্ছে করেই হেঁটে যেতাম আর্কাইভে, পথে তরুণ নিকেতনে থামতাম। যতবারই যাই, দেখি সংবাদপত্রের কাটআউটে ভরা দেয়ালগুলো তাদের আইকনিক স্ট্যাটাস এর জানান দিচ্ছে। শেষবার যখন গেছিলাম, দেখলাম একদল লোক ট্রাইপড নিয়ে হোটেলের ছবি-ভিডিও তুলছে, খুব সম্ভবত তাদের ইউটিউব চ্যানেলের জন্য। পাইস হোটেলে খাওয়া এখন কেতাদুরস্ত ব্যাপার; অন্ততঃ ব্লগপোস্টের শিরোনাম, সোশ্যাল মিডিয়া আর ইউটিউবে উপচে পড়া পাইস হোটেল নিয়ে কন্টেন্ট, ওটিটি শো বা টেলিভিশনের ধারাবাহিক তো সেই কথাই বলে; এমনকি হোটেলের মালিকেরাও নিজেরাই যেন ইনফ্লুয়েন্সার হয়ে উঠেছেন। এ যেন ফেলে আসা সুদিনের প্রতি শহুরে এক স্মৃতিমেদুরতা; সেইসব সময়ের প্রতি আবেগ যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল আর ’স্বাধীন ভারত’ জুড়ে গেছিল তৎকালীন হিন্দু হোটেলের নামের আগে। অথবা মৌলিক ভাবনা চিন্তার ইয়ং বেঙ্গল গ্রুপের নামে খিদিরপুরে এক খাওয়ার হোটেলের নাম হয় ‘ইয়ং বেঙ্গল হোটেল’। ১৯৪৩ সালের দূর্ভিক্ষের সময় স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল ত্রাণ কাজে অংশ নেয়; নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এবং লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাদের নিয়মিত গ্রাহকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আমার পিএইচডির উপদেষ্টা একবার আমাকে পাইস হোটেলে তাঁর সাথে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা-তত্ত্বাবধায়ক সন্দীপ দত্তের মোলাকাতের কথা বলেছিলেন।
১৯৪২ সালে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ উপন্যাসটি লেখার সময় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্ভবত আঁচ করতে পেরেছিলেন শহরের হোটেলগুলিও যুগের সাথে বেড়ে চলা গতিশীলতায় শহরের দৈন্যন্দিন জীবনের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠবে, ঠিক তাঁর উপন্যাসের কাল্পনিক হোটেলের মতোই। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে সেই ছবিই এখন চোখে পড়ে চারদিকে । কোভিড মহামারীর পরে যখন বাইরে খাওয়ার রীতিনীতিতে আসে বদল, তখন কম পুঁজিতে চলতে থাকা পাইস হোটেলগুলি বিপদের মুখে পরে ধুঁকতে থাকে এবং মহামারী-আক্রান্ত বিশ্বায়িত দুনিয়ায় খাওয়ার সাথে সম্পর্কিত পরিছন্নতাবিধির নিত্যনতুন উপায়গুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের বেশ কসরত করতে হয়। ক্যাশ কাউন্টারে ডিজিট্যাল পেমেন্টের জন্য কিউ-আর (QR) কোডের ব্যবহারও নতুন করে শুরু হয়। ব্ল্যাকবোর্ডের উপর চকে লেখা নিত্য পরিবর্তনশীল খাবারের তালিকার সাথে এ এক অদ্ভুত সহাবস্থান।
যখন আমি ২০২২ সালে মহলে গেছিলাম, পেটপুরে দুপুরের খাওয়া সেরে হোটেলের ঠিক উল্টোদিকের একটি বাড়ির রকে পা ঝুলিয়ে বসে মৌরী-চিনি খাচ্ছিলাম যা খাবারের শেষে না খেলেই নয়। তখনই চোখে পড়ল জ্যোমাটোর ব্যাগ পিঠে একজন সাইকেল নিয়ে হোটেলের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। বুঝলাম, পাইস হোটেলেও লেগেছে শহুরে ডিজিট্যাল আধুনিকতার ছোঁয়া ।
ছবি – সৃজিতা বিশ্বাস