চাটের কথকতা
Volume 4 | Issue 12 [April 2025]

চাটের কথকতা <br>Volume 4 | Issue 12 [April 2025]

চাটের কথকতা
—নিলম সারন গৌর

Volume 4 | Issue 12 [April 2025]

নিলম সারন গৌর

অনুবাদ জয়িতা দাস

ছবি – জিতেন্দ্র সিং যাদব

চাট নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে! আগ্রহীরা যে প্রথম নেটদুনিয়াতেই হামলে পড়বেন, সে নিশ্চিত। যদিও কাজটা সহজ নয় মোটেই। গুগল ম্যাপে যদি কেউ নিজের ছোটবেলা খুঁজতে যান, একমাত্র সেই চেষ্টার সঙ্গেই এই পরিশ্রমের তুলনা করা চলে। তাই বলে ইন্টারনেটকে উপহাস করে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ তিন-তিনটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সন্ধান কিন্তু এই নেট ঘেঁটেই পেয়েছি আমি। সে এমন তথ্য, যার হদিশ জানা ছিল না এমনকি আমার আশপাশের চাটওয়ালা কিংবা তাদের মক্কেলদেরও। তা প্রথম তথ্যটি হচ্ছে এই, শাজাহানের আমলে উত্তর ভারতে এর উদ্ভব। সে সপ্তদশ শতকের কথা। সেই সময় যমুনার জলে ক্ষারের মাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় দিল্লির হাকিমরা নিদান দিয়েছিলেন এই পরিস্থিতিতে মশলাদার ভাজাভুজি টক জাতীয় স্ন্যাক্স অবশ্যই দহি সহযোগে খেতে হবে। ভিন্ন মতের দাবি, জায়গাটা মোটেই দিল্লি নয়, বর্তমান উত্তর প্রদেশে এর প্রথম আবির্ভাব। একদা এই অঞ্চল ছিল আর্য সম্প্রসারণের কেন্দ্রস্থল। ফলত দুধ-ভিত্তিক পশুপালন সংস্কৃতির রমরমা ছিল এই অঞ্চলে। সুতরাং উত্তর প্রদেশে যে দহি মিশ্রিত চাটের চল থাকবে এ আর আশ্চর্য কি! আর সে ইতিহাসের আগের যুগ থেকেই ছিল। এই প্রসঙ্গে একটি রোমাঞ্চকর আবিষ্কারের কথা বলতেই হয়। বলছি, দহি বড়ার কথা! এর সংস্কৃত নাম ক্ষীরবট। দ্বাদশ শতকে রচিত একটি বইয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকেই উত্তর প্রদেশবাসীর রসনা এর সঙ্গে পরিচিত ছিল।

আমি অবশ্য চাট বলতে বুঝি চলমান সময়ের চিরন্তন-কথকতাকে। যা পারিবারিক ঐতিহ্য আর ঘরানার মেলবন্ধনে তৈরি। অপূর্ব ইন্দ্রিয়ঘন স্বাদ এর! মনে রাখতে হবে ‘চাট’ শব্দটির উৎস কিন্তু হিন্দি ক্রিয়াপদ ‘চাটনা’— চেটেপুটে খেতে হয় এ এমন জিনিস! জিভে ঠেকালেই এক তিখা-চটপটা আস্বাদ— সে বড় তীব্র, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্মৃতি! আমার জিভে ধরা আছে এর সুখদ আস্বাদ! তেল মাখানো চিক্‌নি তাওয়ায় ঢিমে আঁচে মুচমুচে করে ভাজা চটকানো আলুর বল বা খাস্তা বড়ায় দাঁত ডেবে যাওয়ার মনোহর সুখ— এর ওপর ঘন দহির প্রাচুর্য, আঠালো মধুর মতো গাঢ় তেঁতুল-আদার চাটনি— যাতে মোলায়েম ভাবে মিশে যায় খাট্টা-তিখা ঝাঁঝ আর মিঠি আস্বাদ— সে এক অপূর্ব শিহরণ জাগানো জিভে জল আনা স্বাদ! ভাজা জিরে আর লঙ্কাগুঁড়োর গার্নিশ দেওয়া মালাইদার দহির রসে ডুবে গলে যাওয়া মুগ ডালের তুলতুলে-দানাদার দহি বড়া যখন হালকা চালে জিভের উপর গিয়ে পড়ে, আর খেতে খেতে যখন এর ভেতরকার আসলি চমক— বারিক করে কুচানো আদা, কিসমিস আর ধনেপাতাগুলো আবিষ্কার হয়, সেই নিখুঁত-বিশুদ্ধ চমকের সঙ্গে কি আর অন্য কোনো স্বাদের তুলনা হয়! আর পাপড়ি চাট! কুড়মুড়ে পাপড়িগুলো যখন উচ্ছল উল্লাসে দাঁতের চাপে ভেঙে পড়ে! ওপরে এর শুকনো, প্রায় চটকানো সেদ্ধ ছোলা আর পেঁয়াজ-ধনেপাতার গার্নিশ। অবশ্যই চাটনিতে ল্যাপটানো। ঝাল মসালাদার পুর ভরা টম্যাটো আর করলা! ধোঁয়া ওঠা তাওয়ায় যা চেপে চেপে ভাজা হয়! কিংবা ফুচকা! যাকে গোলগাপ্পাও বলা হয়, তার আজন্মের চেনা শব্দে ফেটে যাওয়ার পর মুখ যখন টকঝাল জলজিরার বন্যায় ভাসে, সে এক অনন্য অনুভূতি! আগেকার দিনে আরেক প্রিপারেশন ছিল আলু-ধনের। সেদ্ধ আলুর টুকরো, টকজল, ধনেপাতার পেস্ট, পুদিনা আর কাঁচা আমের চাটনি— এই ছিল এর উপকরণ। আমাদের এলাহাবাদের চাটে ব্যবহৃত সবকিছুর মাত্রা এমনই নিখুঁত ছিল যে জিভে ঠেকালেই রসনা অপ্রত্যাশিত উল্লাস, বিস্ময় আর উত্তেজনায় ভাসত। ক্রমে ভারতীয়দের পদচিহ্ন অনুসরণ করে নিজের উৎসস্থল থেকে চাট যে দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশে, এমনকি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জেও ছড়িয়ে পড়বে, এ আর আশ্চর্যের কি!

তা এই চাটের মস্ত শৌখিন ছিলেন আমার দিদিশাশুড়ি। জীবনে তিনি পেঁয়াজ-রসুন স্পর্শ করেননি। কিন্তু চাটের জন্য তাঁর জান কোরবান। তবে যে সে চাট নয়, লোকনাথ-ঘরানার চাট চাই তাঁর। লোকনাথ লেন, শতাব্দী প্রাচীন কাল থেকে এখানকার চাট-রাবড়ি-লস্যি আর হরা-সামোসা রসনাবিলাসী এলাহাবাদীদের জাদু করে রেখেছিল। আমার দিদিশাশুড়ির এক পরিচিত রিকশাওয়ালা ছিল। চাট খাওয়ার সাধ জাগলেই ডাক পড়ত তাঁর। তাঁর রিকশোয় চেপে পুরনো শহরের অলিগলি পার হয়ে তিনি গিয়ে হাজির হতেন লোকনাথ লেনে। তাঁর এই চাট-বিলাস নিয়ে আমাদের পরিবারে এক গল্প চালু রয়েছে। দাদি তখন মৃত্যুশয্যায়। চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিল না তাঁর শরীর! ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সেই সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘কী খেতে ইচ্ছে করছে তোমার’? গলার স্বর ক্ষীণ, নিষিদ্ধ জেনেও দিদিশাশুড়ি জবাব দিয়েছিলেন— ‘লোকনাথের চাট’।

আসলে স্বাদ জিনিসটা বড়োই ব্যক্তিগত। নিজস্ব ভাবনা, স্মৃতির সঙ্গে হরবখ্‌ত জড়িয়ে থাকে তা। আমার কাছে চাট যেমন গরমের বিকেল। অন্যদের কাছে হয়ত অন্য কোনো বিশেষ ঋতু। আবার অনেকেই যে-কোনো সময়ে তা উপভোগ করতে পারেন। এক্ষেত্রে অবশ্য আমাদের চাটওয়ালাদের নিজস্ব এক পরম্পরা ছিল। বেলা ফুরোলে তারা গাড়ি নিয়ে বের হত। একবার এক চাটওয়ালাকে এই নিয়ে জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, সকালটা তাদের প্রস্তুতিতেই কেটে যায়। রেফ্রিজারেটর-পূর্বকালে এর উদ্ভব, সুতরাং সেটাই ছিল স্বাভাবিক। আমার ব্যক্তিগত স্মৃতির যে মানচিত্র, তাতে চাট গরমের বিকেল, শৈশবের বাংলোর লন আর ১৯৬০-এর কর্নেলগঞ্জের ছোট্ট বাজারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে।

এলাহাবাদে গ্রীষ্মকালটা আমরা অন্দর আর বাইরেতে সুন্দর ভাগ করে নিয়েছিলাম। সন্ধ্যে আর রাতটা আমরা খোলা জায়গায়— বাগান, ছাদ কিংবা উঠোনে কাটাতাম। রাত পোহাতেই সূর্যটা গনগনে আগুনের গোলা হয়ে উঠত। তারপর বিকেল অব্দি সেকি তাপ! সেই সময়টা আমাদের ঘরেই কাটত। চামড়া ঝলসে দেওয়া গরম লু বইত তখন। সেই গরম হাওয়া ফিসফিস করে কথা বলত ছাদের টালি আর ঘরের দেয়ালের সঙ্গে। সেই হাওয়ার চাপ সামাল দিতে গিয়ে বাড়ির দরজাগুলি কেঁপে কেঁপে উঠত। গাছের শুকনো ডালগুলি নিয়েও তখন সে কি টানাটানি! হাওয়ার দাপটে ডালগুলি থরথর করে কাঁপত! কিন্তু সূর্য অস্ত গেলেই আগুনের ভাঁটার আঁচ ম্লান। গরম বাগান আর আঙিনায় তখন জল ছিটানো হত। সেই জলধারা-সিক্ত মাটি থেকে উঠে আসত এক মিষ্টি সুবাস, যেন মাটি তার ভিজে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। ভেজা ঘাসে পা রাখলে তখন শরীর-মন জুড়িয়ে যেত। আর এই সময়টাই ছিল ঘরের ভেতর থেকে বেতের চেয়ার, কাউচ আর টেবিল-ফ্যান বের করে আনার সময়। এবং আম-তরমুজ কাটতে বসার সময়। ফলসা-জুস আর বেলের শরবতও তরিবৎ করে খাওয়া হত তখন।  লনে আমাদের আইসক্রিম পার্টি শুরু হওয়ার সময়ও ছিল সেটাই। এবং চাট খাওয়ার সময়ও।

আমার ছিল চাট খাওয়ার দুই অলগ-অলগ তরিখা। এক, মা-বাবা-কাকা কিংবা আর্দালির হাত ধরে ব্যস্ত কর্নেলগঞ্জ বাজারে ছুটে যাওয়া। বাজারের সরু গলিগুলো সেই সময় রিকশো, সাইকেল আর কখনো কখনো স্কুটার, কদাচিৎ মোটরগাড়ির আওয়াজে গমগম করত। পৌরসভার জলের লরিগুলো এসে ভিজিয়ে দিয়ে যেত বাজারের কাঁচা রাস্তা। এতে যেমন ধুলো মরত, তেমনি হাওয়ায় লাগত ভেজা-শীতল এক পরশ। চলতে চলতে আমরা যখন পার হয়ে যেতাম সেই মোড়— যেখান থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে কাছাকাছি এক মসজিদের দিকে, ঠিক সেই সময়টায় দোকান আর রাস্তার বাল্বগুলো প্রথম জ্বলে উঠত। এই মোড় থেকে বাঁ দিকের রাস্তা চলে গিয়েছে আমাদের ছোট্ট শিব মন্দিরের পাশ দিয়ে, অন্যটা দিয়ে সামান্য এগোলেই ছিল কৃষ্ণের মন্দির। মন্দিরের পাশেই ছিল উঁচু বেদি দিয়ে চারপাশ বাঁধানো এক সর্বজনীন কুয়ো। এরপর একে একে বরফওয়ালা, ডেয়ারি, মাটির বাসন-কোসন, তালপাতার পাখা, থালাবাসন, হার্ডওয়ার, শাড়ি-জামাকাপড়, স্টেশনারি, মুদির দোকান। এগুলো পেরিয়ে প্রথমে ডান পরে বামে ঘুরলেই আমরা পৌঁছে যেতাম এক খোলামেলা প্রশ্বস্ত চত্বরে। চওড়া চওড়া সব রাস্তা সেখানে। আর এই স্কোয়ারেই বিশাল এক পিপুল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকত আমাদের চাটওয়ালার ঠেলা। জায়গাটা চাটমশালার ঝাঁঝালো-তিখা স্বাদুগন্ধে ম ম করত। সেই ঠেলা ঘেঁষে ছিল জলে ধোয়া সবুজ তরতাজা আনাজপাতির দোকান। এর পেছনে গোল চাতালের ওপর আমাদের হনুমান সিঁদুর-রাঙা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তাঁকে ঘিরে থাকত প্রদীপের আলো। চাট তাই আমার কাছে লাজিজ ডিসই নয় শুধু— সেই সঙ্গে স্মৃতির ঝাঁপিও। যে স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে গ্রীষ্মকাল এবং তপ্তমাটিতে জলসিঞ্চনের পর উঠে আসা মাটিপোড়া গন্ধ। দূরের মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জিনের আজান, পেছনের রাস্তা থেকে ভেসে আসা মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, হনুমান-মন্দিরের প্রদীপের আলো কিংবা বাজারের দোকানগুলোর ঝলমলে জৌলুস— এই সব কিছুই আমার চাট খাওয়ার স্মৃতির সঙ্গে লেপটে রয়েছে।

আমার মনে আছে, এখন আমরা যেটাকে ‘আলু টিকিয়া’ বলি, সেকালে এটাকে ‘চপ’ বলা হত। দহি বড়াও ছিল— এর খাস-পরিচিতি ছিল খোকা রায় নামে এক চাটওয়ালার নামে। আর দশটা চাটওয়ালার ঠেলা থেকে খোকার ঠেলা ছিল ভিন্ন। বিশাল এক ত্রিভুজাকৃতি বাক্স বসানো ছিল তার ঠেলার মাঝখানে। এই বাক্সটি নিয়ে ছিল সবার মস্ত কৌতূহল। শালপাতার ঠোঙায় পাতার চামচ কিংবা হাত দিয়ে খাবার খেতাম আমরা। আইসক্রিমের পাতলা কাঠের চামচগুলো চালু হয়নি তখনও।

বাজারের চাট-অধ্যায় আমার এখানেই সমাপ্ত। চাটের দ্বিতীয় অধ্যায়টি ছিল এর চেয়েও রোমাঞ্চকর। এই পর্বে মশলা আর নমকিনের রাজপুত্র খোদ তাঁর ঠেলা নিয়ে আমাদের বাংলোর বিশাল লনে এসে আবির্ভূত হতেন। লনের চেয়ার, দড়ির খাটিয়া কিংবা বারান্দার সিঁড়িতে বসে থাকা অতিথিরা সব তাঁর কাছ থেকে নিজেদের পছন্দ মতো চাট খেতেন। বাকি থাকত তারাই, যারা কাগজের মতো মুচমুচে, গোল ফুচকা খাওয়ার জন্য আমাদের সেই চাটওয়ালার ঠেলার চারপাশে ভিড় জমাত। তিনি পালা করে পাতলা গোল ফুচকায় আমের গন্ধমাখা টক ঝাল জল-জিরা ভরে তাদের সবার হাতে তুলে দিতেন। মুখটা সামনে এগিয়ে যতটা সম্ভব বড় হা করে তারা সেই কুড়মুড়ে সুস্বাদু বস্তুটি দ্রুত মুখে পুরে দিয়ে হা বন্ধ করে দিত। তারপর সেই ফেটে যাওয়া ফুচকার অনন্য আস্বাদ একঝটকায় গ্রাস করে নেওয়ার অপেক্ষা!

চাট ঘিরে এমন অনেক স্মৃতিই রয়েছে। এর মধ্যে একটি স্মৃতি আমার বিশেষ প্রিয়। আমার মা-বাবা সবে এক ম্যানুয়াল মিনি-প্রজেক্টর কিনেছেন। বিশেষ বিশেষ দিনে সেই প্রোজেক্টর দিয়ে আঙিনায় কাপড় শুকোনোর দড়িতে সাদা চাদর টাঙিয়ে তাতে ছোট ছোট ফিল্ম দেখানো হত। অতিথিরা বসে আছেন, হাতে চাটের প্লেট, খেতে খেতে অবাক হয়ে উপভোগ করতেন সেই সব সিনেমা। প্রজেক্টরের হাতল ঘুরতেই ফিল্মের রিল ধীরে ধীরে যেত খুলে। তখন সেই সাদা পর্দায় ভেসে উঠত আবছা সাদা-কালো নাচের দৃশ্য। দর্শকরা বিস্মিত, পুলকিত। আর আমি! রোববার লক্ষ্মী টকিজে ম্যাটিনি শোতে ছোটোদের ফিল্ম দেখতে ভালোবাসা আমি তো আনন্দে আত্মহারা! যেন পুরো সিনেমাহলটাই উঠে এসেছে আমার বাড়িতে! সেই যে কথায় বলে, ‘মহম্মদ না গেলে খোদ পাহাড়ই চলে আসে তাঁর কাছে’, এ যেন ঠিক তেমনি অবস্থা! তাই বলছিলাম, চাট আর শৈশব— এই দুই আমার স্মৃতির এক অবিশ্বাস্য এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এবার ফাস্ট-ফরোয়ার্ড করে চলে যাওয়া যাক এক অন্য সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাটওয়ালা—মেয়েদের কলেজের জনপ্রিয় আড্ডাটা বসত যেখানে, সেখানে একটা নিচু দেয়ালের ওপর বসে চাট খেতে খেতে আমরা সিমোন দ্য বোভোয়া থেকে পাবলো নেরুদা, হারমান হেস বা আলবেয়ার কামুর লেখা নিয়ে তুমুল আড্ডা দিতাম। আমাদের ঝোলা ব্যাগ থেকে বই আর ভিনাইল রেকর্ড আদান-প্রদান হত। আমাদের পিছু নিত যারা, সেই সব ছেলেদের ওপর আমাদের রাগ হত খুব। আবার ক্লাসরুমের হিরো অধ্যাপকদের নিয়েও আমাদের উচ্ছ্বাস ছিল লাগামবিহীন। কার বেল-বটম প্যান্ট কতটা নীচে নেমে গিয়েছে, সেসব নিয়েও একটা প্রতিযোগিতা ছিল। নিজেদের লেখা কবিতাও আমরা একে অপরের সঙ্গে শেয়ার করতাম। শেয়ার করতাম অ্যাডমায়ারদের কবিতাও। কখনও কখনও এমনও হত, একই কবিতা আমরা অনেকেই পেতাম। তখন সে কি হো হো করে হাসি! কল্পনা করার চেষ্টা করতাম, কীভাবে আমাদের সাহসী প্রেমিকরা সব একসঙ্গে বসে একই কবিতার একাধিক কপি তৈরি করেছে!

সিনেমার রিলের মতো জীবন এগোয়। গুচ্ছ দ্বীপের মতো চাট্‌কে ঘিরে তৈরি হওয়া আমার স্মৃতিগুলোও সব ফিরে ফিরে আসে। মনে পড়ে আমাদের পাড়ার সেই প্রিয় চাটওয়ালার কথা— আমাদের গেটের পাশেই ঠেলা নিয়ে বসতেন যিনি, আমার বাবা-মা তো বটেই, আমার কচি ছেলেপুলেদেরও মন জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর কাজ ছিল, শালপাতার ঠোঙা-ভরা চাট পেতলের থালায় সাজিয়ে আমাদের গেটে পৌঁছে দেওয়া। আর এই কাজ করতেন তিনি আনন্দের সঙ্গেই। মাঘ মাসের স্নান কিংবা কুম্ভমেলার সময়, এলাহাবাদের কনকনে ঠাণ্ডায় চারপাশ যখন কুয়াশাঘেরা, সেই সময় কিছু বিশেষ ক্রেতা এসে জড়ো হতেন আমাদের এই চাটওয়ালার ঠেলার সামনে। তাঁরা সব বাঙালি তীর্থযাত্রী। সঙ্গমে স্নানের জন্য দল বেঁধে আসতেন তাঁরা। উঠতেন আমাদের মহল্লার পাশেই পুরনো এক বাঙালি ধর্মশালায়। সকালে সঙ্গমে ডুব আর পুজোপাঠ শেষে বিকেলে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় তাঁরা এসে জড়ো হতেন চাটওয়ালার ঠেলার কাছে। পরনে মোটা সোয়েটার কিংবা জ্যাকেট আর ফিনফিনে ধুতি। ধুতি এতটাই ফিনফিনে যে ভেতরের লম্বা আন্ডারওয়্যার স্পষ্ট দেখা যেত। মাথায় তাঁদের বাঙালির সেই চিরন্তন ট্রেড মার্ক মাঙ্কি ক্যাপ। বেশ আমোদ করে চাট খেতেন তাঁরা। ভাসতেন উচ্ছাস-আহ্লাদে। এঁদেরই একজন খোলাখুলি স্বীকার করেছিলেন, গঙ্গা-যমুনার পবিত্র সঙ্গমে ডুব দেওয়া, পুজোপাঠ আর গরম কাপড় কেনার পর সন্ধ্যায় এই চাট খাওয়াটাই ছিল তাঁদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমার বন্ধুরা— যারা মুম্বাই, চেন্নাই কিংবা নিউ ইয়র্ক, সিডনিতে চলে গিয়েছিল, তাদের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্যি। প্রবাস থেকে নস্টালজিক সফরে কিছুদিনের জন্য এলাহাবাদে এলে সঙ্গম-দর্শনের পাশাপাশি চাট খাওয়াটাও তখন তাঁদের প্ল্যানের মধ্যেই পড়ত। এলাহাবাদের চাট মানেই নিজস্ব এক সিগনেচার ব্র্যান্ড— চাটনির খাট্টা-মিঠা স্বাদের এমন দুরস্ত টেস্টের বিকল্প হয় না। সহজ-সরল ছিল এর উপকরণ। এজন্যই হয়ত এর স্বাদ বাড়ির খাবারের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। লোকে বলে, চাট! সে তো মেয়েদের— বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা কিংবা হরমোন-ক্ষরণে টগবগ করছে যারা, তাদের প্রিয় খুব। মতটি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। লিঙ্গ-নিরপেক্ষ এই খাবার! আমাদের ‘শিবা চাট’ বা ‘পণ্ডিতজি কি চাট’-এর সামনের লম্বা লাইন অন্তত সেকথাই বলে।

আমাদের মহল্লার প্রিয় চাটওয়ালা তাঁর ঠেলা বিক্রি করে দিয়েছিলেন কবেই! পাশেই একটি নতুন দোকান কিনেছেন তিনি। চার টাকার চাট তাঁর এখন চল্লিশ টাকা হয়েছে। আমার যে ছেলেটা চার বছর বয়সে চাট খেয়ে আহ্লাদে আটখানা হত, আজ সে চল্লিশ বছরের। সময় পাল্টেছে, পাল্টে গেছে সেও। নিজের চার বছরের ছেলেকে ‘জাঙ্ক ফুড’ আর সন্দেহজনক ‘স্ট্রিট ফুড’ থেকে দূরেই রাখে সে। ফিরে তাকাই পেছনে, চলে যাই ১৯৬০-এ। আমাদের অতিথিদের চাট নিয়ে কত উৎসাহ তখন! এখন সব পাল্টে গেছে। বাড়িতে তৈরি চাট চেখে দেখতে আপত্তি না থাকলেও বাজারে থেকে কেনা চাটে এখন আর রুচি নেই কারো। বরং অনেকেই এড়িয়ে চলেন। বিনা কারণে নয় অবশ্যই। রাস্তার খাবার হজম করার জন্য যে ইস্পাতের পেট চাই! যদিও বিয়েবাড়ির চাটের স্টলগুলিতে ভিড় উপচে পড়ে আজও।

চাটওয়ালার ঠেকের সেই আড্ডার দিনগুলো অতীত হয়েছে কবেই। এখন দিনরাত দূষণ, গাড়িঘোড়ার শব্দ আর কখন কোন অপরিচিত বাড়ি ঢুকে যায়, এই ভয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে থাকা! এরমধ্যেই মাঝে মাঝে রসনা তৃপ্ত করার জন্য চাটের সেই তীব্র তিখা-মিঠি স্বাদুগন্ধ স্মরণ করার চেষ্টা করি। আজকাল আমাদের সেই পুরনো চাটওয়ালা হোয়াটসঅ্যাপেও অর্ডার নেন। চাট আসে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের প্লেটে— কিন্তু এখনো সেই পুরোনো পিতলের থালার ওপরেই রাখা থাকে। পাঠিয়ে দেন সেই ব্যক্তি, যাঁর সঙ্গে বহু দশকের চেনাজানা— তিনি কোনো আজনবি নন, আমাদের পরিবারেরই একজন।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

oneating-border
Scroll to Top
  • The views expressed through this site are those of the individual authors writing in their individual capacities only and not those of the owners and/or editors of this website. All liability with respect to actions taken or not taken based on the contents of this site are hereby expressly disclaimed. The content on this posting is provided “as is”; no representations are made that the content is error-free.

    The visitor/reader/contributor of this website acknowledges and agrees that when he/she reads or posts content on this website or views content provided by others, they are doing so at their own discretion and risk, including any reliance on the accuracy or completeness of that content. The visitor/contributor further acknowledges and agrees that the views expressed by them in their content do not necessarily reflect the views of oneating.in, and we do not support or endorse any user content. The visitor/contributor acknowledges that oneating.in has no obligation to pre-screen, monitor, review, or edit any content posted by the visitor/contributor and other users of this Site.

    No content/artwork/image used in this site may be reproduced in any form without obtaining explicit prior permission from the owners of oneating.in.