চিত্র – বিমান নাথ
তুর্কি সুন্দরী সব। অল্পবয়সী। সংখ্যায় পাঁচশো। বেহেস্তের হুরির মতো রূপ তাঁদের। বেতের মতো ছিপছিপে শরীর। ধনুকের ছিলার মতো টানটান, শানিত তাঁদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি। পরনে পুরুষের পোশাক। সবার একই রকম। সাধ্য কি এক থেকে অপরকে আলাদা করে কেউ! হাতে তাঁদের তীর-ধনুক। পিঠে তূণীর। এই মেয়েদের পরিচয়, তাঁরা সুলতানের দেহরক্ষী। দরবারে সুলতানের ডান দিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে তাঁরা।
সুলতানের বাঁ দিকেও একই দৃশ্য। সেদিকেও পাঁচশো সুন্দরী। ভঙ্গি তাদেরও খরশান। রূপ তাঁদেরও উপছে পড়ছে। পোশাকেও কোন তফাৎ নেই। তবে এই অভিন্নতার মধ্যেও একটা ভিন্নতা রাখার প্রয়াস রয়েছে। বাঁ দিকের কন্যারা সব আবিসিনিয়ান। মেঘবর্ণা। বিদ্যুৎবর্ণা তুর্কি সুন্দরীদের বিপরীত। আর হাতে তাঁদের তীর-ধনুকের বদলে আগ্নেয়াস্ত্র। ব্যস্, আর কোনও তফাৎ নেই।
এই সহস্র সুন্দরীর ঝকঝকে চেহারাই বলে দেয় এঁদের গড়ে তোলার পেছনে কতটা আবেগ-যত্ন-উষ্ণতার ছায়া ছিল। ছিল প্রণয়। সুলতানের জান কোরবান এঁদের জন্য। শুধু এই হাজার নারীযোদ্ধাই নয়, তাদের সঙ্গী আরও চোদ্দ হাজার মানবীর উষ্ণ সান্নিধ্যে দিন কেটে যায় তাঁর। সেই উষ্ণতা যাতে হারিয়ে না যায়, যৌনশক্তি বাড়ানোর চেষ্টা চলে তাই। শাহি মেনুতে যোগ হয় এমন সব ওষধি, যাতে বৃদ্ধি পাবে সুলতানের কাম। আহ্লাদ-উল্লাসে দিন কাটে সুলতানের। আফতাবের মতো দরবার আলো করে বসেন তিনি। পঞ্চ সহস্র পরীর দল তাঁকে ঘিরে থাকেন। দরবারের জিয়নকাঠি তাঁরাই। রূপকথার এই দরবারে পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কেন? কারণ, এই দরবার বসত সুলতানের হারেমে, বলছেন ঐতিহাসিকরা– “He accordingly established within his seraglio all the separate offices of a court, and had at one time fifteen thousand women within his palace. Among these were school-mistresses, musicians, dancers, embroiderers, women to read prayers, and persons of all professions and trades.”[i]
সুলতান বিলাসী। নারীতে আসক্ত। তবু এই সুলতানের সামনে আমির-উমরাদের মস্তক শ্রদ্ধায় আনত। তাঁর বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগ নেই। এই সুলতান, এমন সুলতান, যিনি সিংহাসনে বসেই আমির-উমরাদের সামনে ঘোষণা করতে পারেন–
–আমার আর ভাল্লাগছে না, বুঝলে? চৌত্রিশ বছর ধরে ছুটছি তো ছুটছিই। এক ময়দান থেকে আর এক ময়দানে। লড়াই তো আর কম করিনি! পিতৃদেব আমৃত্যু নিশ্চিন্ত ছিলেন। জানতেন, আমার হাতে তরোয়াল থাকলে তাঁর রাজ্যে আঁচ পড়বে না কখনও। সে যে পড়তে দিইনি, এর সাক্ষী তোমরা। কিন্তু এখন আমি ক্লান্ত। এবার বিশ্রাম চাই। যুদ্ধ থেকে। অস্ত্রশস্ত্র থেকে। বাকি জীবনটা আয়েশেই কাটাবো আমি। এ জীবনে আর অস্ত্র স্পর্শ করতে চাই না।
হ্যাঁ, দস্তুর মতো ঘোষণা করেই আয়েশি জীবন বেছে নিয়েছিলেন তিনি। ঘোষণা করেছিলেন, অস্ত্র ধরতে চাই না আর। চাই না মানে চাই না। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাঁর এই মত পাল্টায়নি। প্রতিকূল পরিস্থিতি বলতে বাহলুল লোদির রনথম্বোর আক্রমণের কথা বলছি। আমির-উমরারা আতঙ্কিত। এবার লোদির কোপ যদি পড়ে মান্ডুর ওপর? সুলতানের কানে কথাটা তোলা হয়েছিল। তবে এতে তাঁর কোনো হেলদোল দেখা যায়নি। বেগতিক দেখে আমিররা সুলতানকে তাঁর হারেমের কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। লোদি একবার শহরটা কব্জা করে নিলে সুলতানের হারেমসুন্দরীদের দুর্দশা যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, সেই বর্ণনা বেশ বিশদেই দেওয়া হয়েছিল।
কড়া দাওয়াই। প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে এরপর আর সময় লাগেনি। তাই বলে সুলতান নিজে অস্ত্র ধারণ করতে যাননি। তলব করে পাঠিয়েছিলেন চান্দেরির শাসক শের খানকে। লোদির মুখোমুখি হওয়ার জন্য। সার্থকনামা পুরুষ এই শের খান। বাহলুল লোদি তাঁর সামনে অশ্বের লাগাম টানতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপর আর সুলতানকে রাজ্যের নিরাপত্তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি।
তাঁর যত ব্যস্ততা তখন হারেম নিয়ে। এতে রাজ্যে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল, সে কথা বলতে পারবে না কেউ। বরং ঐতিহাসিকরা বলছেন, “It is an extraordinary fact that no rebellion among his own subjects, nor invasion of the Malwa territories by an enemy…”[ii] ব্যতিক্রম ওই বাহলুল লোদির রণথম্বোর আক্রমণ। নিজে অস্ত্র না ধরলেও সামন্ত প্রধানকে দিয়ে সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে বেগ পেতে হয়নি তাঁর। কারণ সুলতান দুর্বল ছিলেন না। সামন্তরা ছিলেন তাঁর বশ। এবং আমির-উমরারাও– “put out the hand of liberality and lavishness from the sleeve of generosity and made all sections of the people satisfied and grateful.”[iii]
তিনি সুলতান গিয়াসুদ্দিন শাহ্। গিয়াৎ শাহি নামেই অধিক পরিচিতি। পিতা তাঁর সুলতান মাহমুদ শাহ। পিতার মৃত্যু হলে তাঁর এই জ্যেষ্ঠ পুত্রই তখ্তে বসেছিলেন। সে ১৪৬৯ সনের কথা। আর এই তখ্তে বসার কিছুদিনের মধ্যেই এক জশন-এ-জলুসের সমাবেশে মালওয়ার এই নতুন সুলতান উৎসবে সামিল আমির-উমরাদের সামনে ঘোষণা করেছিলেন তাঁর বাসনার কথা– বাকি জীবনটা ব্যসন-যাপনে কাটিয়ে দেওয়াই ইচ্ছে তাঁর।
তা যেমন কথা, তেমন কাজ। জ্যেষ্ঠ পুত্র আবদুলকে প্রধান উজিরের দায়িত্ব সমঝে দিয়ে তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন এক নতুন উপাধি– নাসিরুদ্দিন। বারো হাজার অশ্বারোহীর প্রধানও করে দিয়েছিলেন। রাজ্য এবার আগলে রাখার দায়িত্ব এই নাসিরুদ্দিনের। পিতার আমলে সুলতানের যে ভূমিকা ছিল, তা এবার বর্তাবে পুত্রতে।
সুলতান নিশ্চিত। তাঁর সব মনোযোগ কেড়ে নিল হারেম। তৈরি হল জাহাজ মহল। মহলের দু-পাশে দুই মস্ত ঝিল। দূর থেকে দেখে মনে হত জলের ওপর ভাসছে গিয়াৎ শাহির এই জেনানা মহল। তাই এমন নাম। সুলতানের হারেমসুন্দরীদের নূপুর নিক্বণে গমগম করত সেই মহল।
আর বসত দরবার। যে দরবারের একমেবাদ্বিতীয়ম্ পুরুষ তিনি। পনেরো হাজার হুরির মধ্যমণি। সবমিলিয়ে রূপকথার নায়ক। তাঁর কারনামার গল্প ফুরোবার নয়। যেমন, হারেমের সবার জন্য সুলতান বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন দু’ সের চাল আর দুটি তামার তঙ্কা। না, মাসিক নয়, দিনের হিসেবে। তা একদিন শাহি মহলে তাঁর সাক্ষাৎ এক নেংটি ইঁদুরের সনে। তা ইঁদুর হলেও সে হারেমের বাসিন্দা তো বটে! অতএব রাজভাঁড়ার থেকে ইঁদুরের জন্যও চাল-ডাল-তঙ্কা বরাদ্দ হল। হররোজ। একে একে হারেমের পুষ্যি টিয়ে-পায়রা অ্যান্ড কোম্পানি– বাদ যায়নি কেউই।
না, গল্প নয়– সত্যি। ইতিহাসবিদ ফিরিস্তা দিয়ে গেছেন এসব তথ্য। সুলতানের সবকিছুই ছিল থোড়া হট্কে। এদিকে মনেপ্রাণে সাচ্চা মুসলমান। হররোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া চাই তাঁর। সাতসকালে ঘুম না ভাঙলে ফজরের নামাজ কাজা হবে, এই এক ভয় ছিল সুলতানের। ফলত বাঁদিদের ওপর হুকুম জারি হয়েছিল, যেভাবেই হোক ঠিক সময়ে তাঁকে জাগিয়ে দিতে হবে। এমনকি এর জন্য যদি ঘুমন্ত সুলতানের ওপর জোরজুলুম করতে হয়, কোই বাত নেহি।
তা হুকুম তামিল হত। কখনও তাঁর চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে, কখনও বিছানা থেকে টেনেহিঁচড়ে তুলে কিংবা অন্য কোনও উপায়ে নামাজের আগেই সুলতানের ঘুম ভাঙানো হত। এর জন্য সুলতান কখনও মেজাজ হারিয়েছেন কিংবা কাউকে শাস্তি দিয়েছেন, সেই অভিযোগ শোনা যায়নি। দিলচস্প আদমি বলতে যা বোঝায়, আসলে গিয়াৎ শাহি ছিলেন ঠিক তাই। রুচিশীল ছিলেন। সংস্কৃতিচর্চার প্রতি ঝোঁক ছিল। মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর ব্যাপারেও। সারঙপুরে দস্তুর মতো মাদ্রাসা তৈরি করে দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য। এসবই পঞ্চদশ শতকের শেষ তিন দশকের কথা।
শুনে থমকে গেলেন তো? অবিশ্বাস্য হলেও কথাটা সত্যি। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর। রসিকজনদের কাছে আজও তাঁর মস্ত কদর। হ্যাঁ, ছয়শ’ বছর পরও। এই রব্রবার কারণ অবশ্য অন্য। সুলতানের কদর করেন তাঁরা ‘নিয়ামৎনামা’র জন্য।
নিয়ামৎ– ফার্সিতে এর ভিন্ন ভিন্ন অর্থ। আপনি যদি এর সঙ্গে ‘খানা’ শব্দটি জুড়ে দেন, তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে ভাঁড়ার ঘর। কিংবা পাকশালা। বাহুল্য ছাড়া উচ্চারণ করলে খাজানা। দৌলতও বলতে পারেন। কিংবা প্রাচুর্য। জুতসই একটা উদাহরণ দেওয়ার লোভ হচ্ছে, কারণ শব্দটির প্রয়োগকর্তা খোদ ইবন বতুতা। বাংলা দেশ প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘দোজখ-ই-পুর-নিয়ামৎ’– প্রাচুর্যের নরক। আবার নিয়ামৎ শব্দের অর্থ আমোদ-আহ্লাদ-উল্লাসও হয়। হয়, সম্মান, বখশিশ। সেই সঙ্গে বাদশাভোগ্য খানাও। সহজ বাংলায় যাকে সুখাদ্য বলতে পারি। গিয়াৎ শাহির নিয়ামৎনামার মূল বিষয় এই খানাপিনাই।
অতএব নেমতনামার (বাঙালি জিহ্বা যেমন উচ্চারণে অভ্যস্ত আর কি) অর্থ দাঁড়ালো খানা-খাজানার ইতিহাস। আবার যাপন-উল্লাসের আখ্যানও বলা যেতে পারে। শিরোনাম যে আনোখা, সে স্বীকার করবেন নিশ্চয়ই? তা বইটি সার্থকনামা। আর দশটা রেসিপি বুকের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। খানাপিনার অতিরিক্ত আরও সব আনমোল খাজানার সন্ধান রয়েছে বইটিতে। ফলত ভোজনরসিক থেকে কলাবিদ, পড়ুয়া, ভাষাবিদ– প্রত্যেকের কাছেই বইটির মস্ত কদর।
কেন? কারণ, এতে রয়েছে পঞ্চদশ শতাব্দীর মালওয়া-ঘরানার এক ঝলমলে ছবি। জানদার, জোশিলা সেই ছবি। অভিজাত সমাজ এখানে জীবন্ত। তাঁদের শখ-আহ্লাদ, রুচি– সে পোশাকই হোক কিংবা খানাপিনা, অন্দরসজ্জা, তয়-তরিখা-দস্তুর– সব নিয়েই। ঐতিহাসিকদের ধারণা বইটি লেখা হয়েছিল গিয়াৎ শাহের শেষ জীবনে। তাঁর মৃত্যু ১৫০০ সনে। আর বইটি লেখা হয়েছিল সম্ভবত ১৪৯৫ থেকে ১৫০৫ এর মধ্যে। কারণ, নেমতনামার সঙ্গে জুড়ে আছে গিয়াৎ শাহের পুত্র সুলতান নাসিরুদ্দিনের নাম। ‘নিয়ামৎনামা-ই-নাসির অল-দিন-শাহি’– বইটির পুরো নাম। গিয়াৎ শাহির সময়কার ছবি ও লেখার পাশাপাশি নাসিরুদ্দিন নিজেও কিছু সংযোজন করেছেন এতে।
প্রসঙ্গসূত্রে বলে রাখি, গিয়াৎ শাহির মৃত্যুর কারণ কিন্তু তাঁর এই পুত্রই। নাসিরুদ্দিন পিতার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন রাজ্য। আর এর চারমাসের মধ্যেই গিয়াৎ শাহির মৃতদেহ পাওয়া যায় তাঁর হারেমে। সন্দেহ, সুলতানের ওপর বিষপ্রয়োগ করেছিলেন নাসিরুদ্দিন। তথ্যদাতা ফিরিস্তা। তাঁর বক্তব্য, সুলতান বৃদ্ধ হতেই তখ্ত নিয়ে শাহি মহলের অন্দরে শুরু হয়েছিল ষড়যন্ত্র। শুরুয়াত ১৪৯৭-তে। গিয়াৎ শাহের ছোটো ছেলে সুজাৎ এই সময় তখ্তের দাবিদার হয়ে ওঠেন। নাসিরুদ্দিন মান্ডুর বাইরে। তবে প্রধান উজির হিসেবে দরবারে তাঁর প্রতিপত্তি ছিল। বশংবদ আমির-উমরাদের মাধ্যমে খবরটা পেতে সময় লাগেনি তাঁর। দেরি না করে নাসিরুদ্দিন ছুটে এসেছিলেন মান্ডুতে। নাসিরুদ্দিন-ঘনিষ্ঠ আমিররা দুর্গের তারাপুর দরওয়াজা খুলে রেখেছিলেন। নাসিরুদ্দিনের ভয়ে ভীত-ত্রস্ত সুজাৎ তখন আশ্রয় নিয়েছিলেন পিতার মহলে। গিয়াৎ শাহি পারেননি পুত্রকে রক্ষা করতে। নাসিরুদ্দিন হত্যা করেন ভাইকে। ভ্রাতুস্পুত্রদেরও। সেইসঙ্গে তাঁর পরিবারের অন্যান্যদের।
প্রশ্ন হল, কেন আমিরদের বিশ্বাসঘাতকতা? গিয়াৎ শাহির প্রতি তাঁদের আনুগত্যে তো কোনো খামতি ছিল না। তবে? এর কারণ নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে অন্য একটি সূত্র। দাপুটে এক হারেমসুন্দরী, যাঁর নাম খুরশিদ বেগম, তাঁর ওপর নাকি এই সময় রুষ্ট হয়ে ওঠেন আমির-উমরারা। গিয়াৎ শাহির প্রিয় বনিতা এই খুরশিদ। মাণ্ডুর রাজপাট তখন চলত তাঁর হুকুমেই। খোদ সুলতানের এতে প্রশ্রয় ছিল। তখ্ত হাসিল করতে সুজাৎ তাই খুরশিদের দলে ভিড়েছিলেন। দরবারে নারীদের আধিপত্য কোনোকালেই প্রশ্রয় পায়নি। আমিররা এতে বিরক্ত হয়েছেন। ফলত সুজাতের প্রতিপক্ষ নাসিরুদ্দিনের ওপর ছিল তাঁদের নেকনজর। বিশ্বাসঘাতকতার কারণ এই। নাসিরুদ্দিন ক্ষমা করেননি খুরশিদকে। সুজাৎকে হত্যার আগেই বন্দি করা হয়েছিল তাঁকে।[iv]
তখ্ত হাসিলে নাসিরুদ্দিনের সহায়, তবু পরবর্তীতে এই দরবারিদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি নাসিরুদ্দিন। সন্দেহপ্রবণ ছিলেন। এতে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তরান্বিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুও। তবে এক নেক-কাম করেছিলেন তিনি। অসম্পূর্ণ নেমতনামার কাজ সম্পূর্ণ করে গিয়েছিলেন। ভাগ্যিস নেমতনামার একটি কপি সযত্নে রাখা ছিল ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে। নয়ত গিয়াৎ শাহির কারনামা আড়ালেই থেকে যেত। আড়ালে থেকে যেত এহেন খাজানা।
নেমতনামার আগাগোড়া চমকে ঠাসা। এর শুরুয়াত আরশোলার বন্দনা দিয়ে। না, ভুল শোনেননি। আরশোলাই। বলা হচ্ছে, “ইয়া কেবক্’… ওহে আরশোলাদের সুলতান! মেহেরবানি করে এই দুনিয়ার রন্ধনশিল্পে আমার এই নৈবেদ্য খেয়ে ফেলবেন না যেন…।” একদম বোল্ড নস্খে লেখা। ফ্রান্সিস স্টেইনগাস, ফারসি ভাষার ওপর ছিল যাঁর অগাধ দখল– তিনি বলছেন, এককালে ভারতে, এবং অন্যত্রও, প্রাচীন পুথিগুলির সূচনাতে এমন প্রার্থনা আকছার দেখা যেত। অবশ্যই সংস্কার থেকে। লোক-বিশ্বাস, আরশোলারা তাদের মহারাজার উল্লেখ দেখে ভয় পাবে। ফলত বইটি থাকবে অক্ষত। নেমতনামার ক্ষেত্রে গিয়াৎ শাহি ঝুঁকি নিতে চাননি। শুরুতে তো বটেই, শেষ অংশেও জুড়ে দিয়েছেন এই আর্জি।[v] সুলতান ‘কেবক’-এর মহিমা এমনই!
এমন চমক নেমতনামার প্রতিটি পৃষ্ঠা জুড়ে। রেসিপি থেকে অলংকরণ, সবেতেই। শুধু এর অলংকরণ নিয়ে লিখতে বসলে গোটা একটা মহাভারত লেখা হয়ে যায়। মিনিয়েচার ছবির ভাণ্ডার এই বই। মোট পঞ্চাশটি ছবি। প্রতিটি এক সে বড়কর এক। ফ্যাশন, তয়-তরিখা, স্থাপত্য সব নিয়ে সমকালীন আভিজাত্য ও সুলতানি ঘরানাকে বিম্বিত করছে ছবিগুলি। মিনিয়েচারের দক্ষিণি-ইসলামিক ঘরানার শুরু এই ছবিগুলি দিয়েই। সিরাজি আর মধ্য ও পশ্চিম ভারতের মিনিয়েচার ঘরানা– এই দুইয়ের মিলাওটে তৈরি এই দক্ষিণি স্টাইল।
‘সিরাজি’! থমকে গেলেন তো? শুধু দুটি নাম উচ্চারণের অপেক্ষা! সিরাজি ঘরানাকে মনে হবে তখন অতি পরিচিত। বলছিলাম, সাদি সিরাজি, হাফিজ সিরাজির কথা! আমাদের প্রিয় নাম, প্রিয় মানুষ তাঁরা।
‘আমরা দুজনে দুজনকে, এসো,
বাহু দিয়ে বাঁধি, সরে এসো কাছে;
পুরনো স্মৃতির ভার বওয়া মিছে,
অতীত তুলো না; যা গেছে তা গেছে।’
হাফিজের কবিতা। অনুবাদ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। ‘সিরাজি’, এ ছিল সাদি আর হাফিজের বড় প্রিয় পরিচয়। সিরাজ– পারসিদের প্যায়ারের শহর। তাঁদের সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান। এই সিরাজ থেকে সিরাজি। সাদি আর হাফিজের অহংকার এই ‘সিরাজি’ পরিচয়। সেই কোন প্রাচীন যুগ থেকে জন্ম-শহরের নাম ধারণ করে আসছেন শায়েররা। সাদি-হাফিজ সেই ধারা বহন করেছেন। পারস্যের এই সিরাজ শহর জানে সাদি আর হাফিজের প্রথম সব কথা। তাঁদের গজলের ধুন এই শহরেই প্রথম ঝড় তুলেছিল।
এহেন সিরাজ শহরের ছিল নিজস্ব ঘরানা। সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতিতে। নেমতনামার প্রথম কয়েকটি ছবি এই সিরাজি ঘরানাতেই আঁকা। ক্রমে পারসি ঘরানার ওপর প্রভাব ফেলেছে ভারতীয় ধারা। আস্তে আস্তে পোশাক, স্থাপত্য, মুখের ড্রইং– সব পাল্টে পাল্টে গেছে। পারসি ধারা ক্রমশ অন্তঃসলিলা। এই সঙ্গম আকৃষ্ট করেছে গবেষক-কলাবিদ-শিল্পীদের।
এবং এর স্টাইলও। ছবির চারপাশের মার্জিন যেমন। সেখানে রয়েছে ছবির বর্ণনা। সেই বয়ানের যে অংশে মূল বিষয় এসেছে, কিছু কিছু ছবিতে সেই অংশ লাল কালিতে হাইলাইট করা। বাকিটা কালোতে। হাতের লেখা টানা। কোন রান্নার প্রিপারেশন চলছে, তা বলে দেওয়া হয়েছে মার্জিনে। পোলাও, হালুয়া, শরবৎ, সামোসা, শিক কাবাব থেকে পান-তাম্বুলের প্রসাধন, সুলতানের শিকার-যাত্রা, মাছ ধরা, জল ঠাণ্ডা করার দৃশ্য, অ্যারোম্যাটিক পেস্ট-ওষুধ-পারফিউম কিংবা শয্যাসুখ বর্ধক খাবার– বাদ যায়নি কিছুই। হেলদি লাইফ স্টাইল কিংবা সুগন্ধির ঘরেলু ব্যবহার– নেমতনামায় এই নিয়ে বক্তব্য রাখছেন খোদ সুলতান। সম্মুখে তাঁর মুরিদের দল আগ্রহী শ্রোতা।
আর এর প্রতিটি ছবিতে হাজির সুলতান। সমস্ত যজ্ঞের ঋত্বিক তিনি। তত্ত্বাবধায়ক। মুখে তাঁর তৃপ্তি। উপভোগ করছেন সুলতান। এই বিশাল যজ্ঞ, নাকি যজ্ঞ-ব্যস্ত সুন্দরীদের উপস্থিতি– সে বোঝা মুশকিল। ছবি বলছে, পুরুষ বাবুর্চি নয়– মেয়েরাই ছিলেন সুলতানের পসন্দিদা রসুইকর। ফলত ছবিতে পুরুষরা আছেন বটে, তবে তাদের উপস্থিতি তেমন করে চোখেই পড়ে না। শিকার দৃশ্য কিংবা সুগন্ধি তৈরির মতো কয়েকটি ছবি বাদ দিলে অন্যান্য ছবিতে পুরুষদের কোনো ভূমিকাই নেই। এমনকি সম্রাট যেখানে মাছ ধরতে ব্যস্ত, সেখানেও হাজির পরির দল। নেমতনামার প্রতিটি ছবিতেই হারেমসুন্দরীদের জয়জয়কার। গিয়াৎ শাহির সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়েছেন তাঁরা। সুলতানের মুগ্ধ দৃষ্টিও।
সব মিলিয়ে এক রূপকথা। এই নেমতনামা। যার প্রতিটি ছবি এক স্বতন্ত্র আখ্যানের কথা বলে। সেই আখ্যান শোনার জন্য ডুব দিতে হয় ছবিগুলিতে। এখানেই আর দশটা পাকশাস্ত্র থেকে নেমতনামা আলাদা। আলাদা এর ভাষার জন্যও। নেমতনামার ভাষা প্রাথমিক উর্দু। অতএব অনেকটাই ফারসি প্রভাবিত। উর্দু ভাষার বুনিয়াদ সবে তৈরি হচ্ছে তখন। নেমতনামা তাই ভাষাবিদ-গবেষকদের আগ্রহও কেড়ে নিয়েছে। আগ্রহ তাঁদের নেমতনামার ক্যালিগ্রাফি নিয়েও। কারণ, মান্ডুর ক্যালিগ্রাফির রয়েছে আলাদা এক বৈশিষ্ট্য। বোল্ড এর নস্খ। বোল্ড গিয়াৎ শাহিও। নেমতনামায় শাহি খানাপিনার প্রিপারেশন যেমন বাত্লে দিচ্ছেন তিনি, তেমনি শেয়ার করছেন যৌন শক্তিবর্ধক খাবারের গুহ্য প্রিপারেশন। প্রাচীন এই চর্চা। রাজপ্রাসাদের অন্দরে অন্দরে এর অনুশীলন চলে এসেছে সে কোন আদিম যুগ থেকে। কিন্তু গিয়াৎ শাহির আগে কিংবা পরে, আর কোনো রাজা-বাদশাই প্রকাশ্যে এই নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি। যদিও এঁদের মধ্যে অনেকেই রেসিপি বুক লিখে গেছেন। নেমতনামার দৌলতে সেই গুহ্য চর্চা জনসমক্ষে এলো।
গিয়াৎ শাহির বাহাদুরি এখানেই। শাহি খানদানগুলির মধ্যে যে এই প্রিপারেশনগুলির আদানপ্রদানও চলত, নেমতনামা দিচ্ছে সেই তথ্যও। দিলওয়ার খান ঘোরি। গিয়াৎ শাহির পূর্বপুরুষ। মালওয়ার প্রথম সুলতান এই দিলওয়ার। দিল্লির সুলতান তখন ফিরোজ শাহ তুঘলক। সে চতুর্দশ শতাব্দীর কথা। দিলওয়ার ছিলেন ফিরোজ শাহের প্যায়ারের লোক। তাঁর দৌলতেই দিলওয়ারের মালওয়ার শাসক হওয়া। পরবর্তীতে সুলতান। তা দিল্লি ছেড়ে আসার সময় এক গজব রেসিপি নিয়ে এসেছিলেন তিনি মালওয়ায়। সে শয্যাসুখ বৃদ্ধির রেসিপি। খোদ ফিরোজ শাহের প্রিয় ছিল এই রেসিপি। মালওয়ার সুলতানদের মধ্যেও জনপ্রিয় ছিল তা। পুরুষানুক্রমে। সেই রেসিপি গিয়াৎ শাহি শেয়ার করেছেন নেমতনামায়। সঙ্গে এমন আরও অগুন্তি রেসিপি।
গুহ্য রেসিপির প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। শুরুতে অন্য এক জবরদস্ত রেসিপি শেয়ার করা যাক। পাঠকরা ঘরোয়া পার্টিতে ট্রাই করে দেখতে পারেন। বন্ধুমহলে আপনার খাতিরদারি বেড়ে যাবে, সে নিশ্চিত। প্রিপারেশনের নাম, মোঙ্গল ইয়াখ্নি। এর জন্য চাই পাহাড়ি ভেড়া। সঙ্গে বুনো পাখি। অভাবে হরিণ। তবে এর আসলি সোয়াদ পাওয়া যাবে ওই ভেড়া আর বুনো পাখির মাংসতেই। পার্বতী ভেড়ার অভাব? কুছ পরোয়া নেই। কাজ চালান সাধারণ ভেড়া দিয়েই। প্রথমে কাঠের মুগুর দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ভেড়ার মাংস নরম করে নিন। পরে আঁচে বসিয়ে সুসিদ্ধ। এবার হিং, এলাচ দানা, লবঙ্গ, জিরে-মেথি বাটা, গোল মরিচ, নুন, আদা-পেঁয়াজ আর মিষ্টি সুবাসিত ঘি মেশালেই মোঙ্গল ইয়াখ্নি তৈরি। খাবার আগে অবশ্যই মাংস চিপসের মতো পাতলা করে কেটে নিতে হবে। সালামির মতো। গিয়াৎ শাহির নিদান, এর সঙ্গে চাই লাইম জুসের ডিপ। নয়ত এর আসলি টেস্ট থেকে বঞ্চিত হবেন।
পড়তে পড়তে নোলা সক্সক্, সে জানি। রোস্টের এক লাজবাব রেসিপিতে কাত হয়ে যাবেন আরও। বনভোজনের উল্লাস থেকে ফার্ম হাউসের নিবিড় যাপন– এই প্রিপারেশন সর্বত্র হিট হওয়ার মতো। তবে ফ্ল্যাটবাড়িতে ট্রাই করতে যাবেন না। কারণ এর জন্য চাই ক্লে-ওভেন– মিট্টি কা চুল্হা। চাই মাটি। সেই মাটিতে খুঁড়তে হবে গর্ত। রাজধানীর বাইরে, সুলতান যখন পথিক, শিকার কিংবা প্রমোদ-ভ্রমণের উদ্দেশে তাঁর যাত্রা, তখন এই প্রিপারেশন ঠাঁই পায় তাঁর মেনুতে। সেপাই-সান্ত্রিরাও বাদ যায় না। সুলতানের বাবুর্চিরা ক্লে ওভেনে তখন তৈরি করে পাঁচ-ছশো আদমির খাবার। রান্না হয় রোস্টেড বিফ কিংবা মাটন। এর জন্য চাই দু’ গজ লম্বা, দেড় গজ চওড়া গর্ত। প্রথমেই গর্তটি আগুন জ্বালিয়ে প্রি-হিট করে নিতে হয়। যেমন-তেমন গরম হলে চলবে না। একেবারে আগুনে গরম হওয়া চাই। গর্ত গরম হলে এর ভেতর ছোটো ছোটো পাথর রিঙের মতো সাজিয়ে রাখতে হয়। একের পর এক। পরে এগুলোও আগুন জ্বালিয়ে জ্বলন্ত কয়লার মতো করে নিতে হয়।
উপকরণ সেই পার্বতী ঘোড়া। অথবা বিফ। বলছেন গিয়াৎ শাহি। সঙ্গে মোঙ্গল ইয়াখ্নির মশলার প্রিপারেশন। বাড়তি শুধু হলুদ, লেবুর রস আর ঘি। আর কিছু মরশুমি সবুজ শাক-সবজি। এই সমস্ত কিছু দিয়ে মাংস ভালো করে মেখে নেওয়া চাই। পরে সেই গরম গর্তে কলাপাতা বিছিয়ে কিছুটা মাংস এর ওপর রেখে চাপা দিতে হবে আবারও কলাপাতা দিয়ে। সেই তাকের ওপর চড়ান হবে জ্বলন্ত পাথর। এর ওপরে আবারও কলাপাতা। এবং আরও এক তাক মাংস। এভাবে মাংস-কলাপাতার কম্বিনেশনের ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেওয়া হবে গরম পাথরের চাদর। কলাপাতা-মাংসের এই মিনার ক্রমশ উঁচু হবে, যতক্ষণ না সব মাংস শেষ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে দশ-বারোটি বা এরও বেশি ভেড়ার মাংস নিতে আপত্তি নেই। সমস্ত মাংস কলাপাতার চাদরে মুড়ে দেওয়ার পরই কিন্তু গর্তটি তড়িঘড়ি বুজিয়ে দেওয়া চাই। কাদামাটি দিয়েই। নয়ত ভেতরের স্টিম বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। গর্ত গরম রাখার জন্য এর ওপর জ্বালানো হবে খড়ির আগুন। এরপর আর কি! জিভে জল নিয়ে শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা! অপেক্ষা তখন অন্তিম মুহূর্তের জন্য, যখন জ্বলন্ত অঙ্গার সরিয়ে গর্ত খুঁড়ে বের করে আনা হবে সেই রোস্টেড মাংস, যাতে লেপটে আছে কলাপাতা আর পোড়া-মাটির খুশবু। ভিনিগার কিংবা লেমন জুসের ডিপে খুলবে এর সোয়াদ। যে সোয়াদে তৃপ্ত হবে আপনার রসনা।
এমনি সব লজ্জতদার রেসিপির সন্ধান রয়েছে নেমতনামায়। রয়েছে ক্লে-ওভেনের অজস্র রেসিপিও। আসলে শিকার ছিল গিয়াৎ শাহির প্যাশন। তা বনে-জঙ্গলে কি আর সবসময় হাতের কাছে হাঁড়ি-কড়াই থাকে! তবে এই নিয়ে গিয়াৎ শাহির বাবুর্চিরা হাহাকার করতে যায়নি। যে জমিনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তারা, সেই জমিনটাকেই বর্তন বানিয়ে দিব্যি এর মধ্যে দিলখুশ খানা প্রস্তুত করেছে। আর এর উত্তরাধিকার তারা অর্জন করেছে তাদের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে। যে ভূমি ছিল তাদের পূর্বজদের, সেই মধ্যপ্রাচ্যে ছিল এর বহুল প্রচলন। সেই উত্তরাধিকার বহন করেছে তারা। তবে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ হয়নি। আর হয়নি বলেই নতুন নতুন তরিখা আবিষ্কৃত হয়েছে। এতে প্রিপারেশন হয়েছে আরও নাজুক। আরও ডেলিকেট। মশলার সূক্ষ্ম ব্যবহারে এর আভিজাত্য বেড়েছে। ক্লে-ওভেনে জায়গা পেয়েছে ফুল। গরম মাটির গর্তে চটকানো সুগন্ধি ফুলের কার্পেট বিছিয়ে এর ওপর রান্না করা হয়েছে মাংস। সঙ্গে কলাপাতা-মাংস-পাথরের লেয়ার। সেই লেয়ারের প্রতিটি ভাঁজেও আবার গুঁজে দেওয়া হয়েছে ফুল। গর্ত বন্ধ করার আগেও। কলাপাতা আর মিট্টির সঙ্গে সঙ্গে ফুলের আঘ্রাণে পুষ্ট হয়েছে এই ঝলসানো খাবার। সময়ের দেয়াল টপকে সেই খোশবাই আজও আমাদের নাসিকা ছুঁয়ে যায়। আমরা চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করি এই অন্ন-যজ্ঞ। ভিনদেশি এক ঘরানা তাদের তয়-তরিখা-তহ্জিব দিয়ে মন জয় করে নেয় আমাদের।
মুশকিল হল এক সে বড়কর এক রেসিপি রয়েছে নেমতনামায়। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি? মৎস্য বিহনে বাঙালির রসনা তৃপ্ত হয় না। অতএব এক্ষেত্রে মাছের একটা রেসিপি অবশ্যই উল্লেখের দাবি রাখে। মচ্ছি-লোফের রেসিপিটা ইউনিক বলে ইল্লেখ করা হল সেই প্রিপারেশনটাই। ঘরে দীর্ঘদিন রেখে দেওয়া যায় এই খাবার। আচমকা ঘরে অতিথি হাজির হলে নো টেনশন। সার্ভ করুন এই মচ্ছি-লোফ। চমকে যাবেন আপনার অতিথিরা। গিয়াৎ শাহির কল্যাণে আপনার হাতযশ সুনাম ছড়াবে। এবার এর অনন্য প্রিপারেশন-কথা। এক্ষেত্রে প্রথমেই কাঁটা ছাড়ানো মচ্ছি চাই। চাই গরম তেলে হিঙের ফোড়ন। সেই ফোড়নে ভাজা হবে মাছের কিমা। পরে, তাজা লেবু পাতা, এলাচ দানা, লবঙ্গ, জিরে-মেথি বাটা, নুন, লেবুর রস আর তেল মাখিয়ে পুরো একটি রাত মেরিনেট হবে সেই মচ্ছি কিমা। লক্ষ রাখবেন, মিশ্রণটা যেন ময়দার তালের মতো শুকনো হয়। পরদিন সেই তাল দিয়ে ছোটো ছোটো লোফ তৈরি করে বেক করুন। কড়া রোদে। পরে কৌটোবন্দি করে তুলে রাখুন। ভাজার প্রয়োজন নেই। মচ্ছি-লোফ এমনিতেই টেস্টি। তবে ডিপ-ফ্রাইতেও আপত্তি নেই। চাইলে এই প্রিপারেশন মচ্ছির বদলে কোয়েল, তিতির কিংবা হরিণের মাংস দিয়েও ট্রাই করতে পারেন। জিভ যে ঠকবে না, সে হলফনামা দিয়ে দেওয়া হল।
খানা-খাজানার এই দাস্তান সহজে ফুরানোর নয়। সুলতানি রসুইঘর মানেই পেঁয়াজ-রসুন-মাছ-মাংসের খোশবাই– এই ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণিত করে গিয়াৎ শাহির দস্তরখ্বানে শোভা পেয়েছে দুর্ধর্ষ সব ভেজ আইটেম। বয়োবৃদ্ধদের বলছি, নিরামিষ সেই পদগুলির বর্ণনা আপনাকে স্মৃতিমেদুর করে তুলবেই। সময়ের দেয়াল টপকে বিধবা মা-ঠাকুমা-দিদিমা কিংবা পিসিমাদের হাতে তৈরি নিরামিষ ব্যঞ্জনের আঘ্রাণ আপনার নাক ছুঁয়ে যাবে। এতটাই মনচোরা নেমতনামার নিরামিষ প্রিপারেশন। মাছমাংসের ব্যঞ্জন এর পাশে নস্যি। শসা আর তরমুজের বীচি দিয়ে তৈরি নেমতনামার সেই বিখ্যাত দেবভোগ্য বড়ি নিরামিষ তরকারিতে যোগ করে দেখুন– আস্বাদে পবিত্র, তৃপ্ত হবে আপনার মন। তৃপ্ত হবে উদরদেশও। এর জন্য আপনাকে শুধু অল্প ময়দার সঙ্গে বড় তরমুজ আর সসার বীচির বাটা দিয়ে তৈরি করতে হবে ছোটো ছোটো বড়ি। সেই বড়ি ভাজতে হবে ঘিতে। পরের ধাপে বেক। সঙ্গে থাকবে কিছু পটহার্ব। হয়ে গেলে সামান্য কর্পূর আর গোলাপজল। সাধারণ উপকরণ। এবং সহজ-সরল পদ্ধতি– ব্যস্ এতেই বাজিমাৎ! ট্রাই করে দেখবেন নাকি আপনার মডিউল্যার কিচেনে? ভোজনবীরদের মন জয় করে নেবেন নিশ্চিত।
বলা হয়নি, নেমতনামার প্রায় প্রতিটি রেসিপিতেই কিন্তু কস্তূরী হাজির। সঙ্গে হিং, খাঁটি ঘি, অ্যাম্বারগ্রিস আর জাফরান। হিং এবং খাঁটি না হলেও ভেজাল ঘি মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যেই। কিন্তু কস্তুরী? এর সঙ্গে আমাদের পরিচয় পুথি-পত্রেই আটকে আছে। জাফরানের শকল্ কদাচিৎ দেখলেও আম বাঙালি এর আস্বাদসুখে বঞ্চিত। মধ্যবিত্তের হেঁশেলে তাই খাঁটি সুলতানি খানার আস্বাদ পাওয়া হয়ত সব ক্ষেত্রে সম্ভবপর নয়। তবে ব্যতিক্রম রয়েছে। আর রয়েছে বলেই নেমতনামার এত কদর। শিক-কাবাব রোল কিংবা কিমা-কোফতার কথাই ধরুন না! সুলতানি এই খাবার কয়েক-শ’ বছর পেরিয়ে আজও যে সমান জনপ্রিয়, সে তো এর সহজ-সরল উপকরণের জন্যই। কিমা কোফতার জন্য প্রথমেই সেদ্ধ মুগ ডাল ও মাংসের কিমার মিশ্রণ দিয়ে তৈরি করতে হবে বল। ভাজতে হবে গরম ঘিতে। এর গ্রেভি তৈরি হবে কিসমিস, আমন্ড, পেস্তা, পাইন নাট্স্, চিরোঞ্জি আর নারকেল বাটার মিশ্রণে। নামানোর আগে কর্পূর আর গোলাপজল। ব্যস্, তৈরি আপনার কিমা-কোফতা। গিয়াৎ শাহি যদিও সাদা অ্যাম্বারগ্রিস আর কস্তূরীর কথা বলেছেন, আমরা না হয় এলাচ-দারুচিনিতেই কাজ চালিয়ে নেবো।
আর শিক-কাবাব রোল? এর জন্য হলুদ, নুন, পেঁয়াজই যথেষ্ট। সঙ্গে কিছু সবুজ শাক সবজি। সব একসঙ্গে মাখিয়ে সামান্য সেদ্ধ করে নিতে হবে। পরে আঁচ থেকে নামিয়ে শিকে পরপর মাংসের ছোটো ছোটো পিস, সবজি আর পেঁয়াজ গেঁথে ভালো করে ঘি, কেওড়া, অ্যাম্বারগ্রিস, গোলাপজল, নুন আর লেবুর রস মাখিয়ে বেক করে নিলেই হল। পাতলা রুটিতে মুড়ে নেওয়ার অপেক্ষা শুধু– তৈরি শিক-কাবাব রোল।
এমন হাজারো প্রিপারেশনের ছড়াছড়ি এতে। পোলাও, ভাত, বড়ারও কত না রকমফের! কিছু কিছু প্রিপারেশন চমকে দেওয়ার মতো। একেবারে বাদশাহি ঘরানার। আবার কিছু প্রিপারেশন একেবারেই সাধাসিধে। আমাদের মতো আম বাঙালির হেঁশেলেও এই সুলতানি খানা মানিয়ে নিতে পারে ঠিক। খিচুড়ির রেসিপি যেমন। কিংবা খাজা, লাড্ডু, শরবতের। এগুলির নানা রেসিপি রয়েছে নেমতনামায়। সামোসারও। শুনে চমকে গেলেন তো? পঞ্চদশ শতকে সামোসা? হ্যাঁ, ছিল। সুলতানি আমল থেকেই ভারতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই সামোসা। এতটাই যে গিয়াৎ শাহি বাধ্য হয়েছেন এর একাধিক রেসিপির উল্লেখ করতে। জানার কৌতূহল হচ্ছে? পার্বতী ভেড়ার মাংসে তৈরি সামোসার এক স্পেশাল প্রিপারেশন শুনুন তাহলে।
পার্বতী ভেড়া মানে পাহাড়ি ভেড়া। এর মাংস কিমা করে নিন। হলুদ, জিরে, মেথি, ধনে, এলাচ, লবঙ্গ দিয়ে ভালো করে মাখুন। কড়াইতে ঘি চাপিয়ে হিং ফোড়ন দিন। ঘিয়ের গন্ধ জোরালো হয়ে এলে কিমা দিয়ে দিন কড়াইতে। সেদ্ধ হয়ে এলে লেবুর রস, গোলমরিচ, আদা-পেঁয়াজ মিশিয়ে আঁচ থেকে নামিয়ে এক রতি করে কর্পূর আর কস্তূরী মেশান। এই পুর দিয়ে সামোসা তৈরি করে ঘিতে ভেজে নিন। সামোসার সাইজ হবে দু-রকম। বড় এবং ছোটো। এক কামড়েই খাওয়া যাবে, ছোটোগুলোর সাইজ হবে এমন। আর হ্যাঁ, এর সঙ্গেও চাই ভিনিগার কিংবা লেবুর রস।
ভোজনরসিকরা বলেন, নেমতনামা আর আরব্য রজনীর কিস্সায় তফাৎ নেই কোনো। যত পড়বেন, আপনি ডুবে যাবেন আরও। সে এক অদ্ভুত নেশা! পাঠকালে বাস্তব আর কল্পজগতের হদিশ গুলিয়ে যায়। নাকের ওপর কস্তূরীর খোশবাই আর ঘাড়ের ওপর পরীর দল নিঃশ্বাস ফেললে এমনই হয়। পাঠ আর পাঠকে তখন তফাৎ থাকে না কোনো। স্বর্ণ পল্লবের গার্নিশ করা জুঁই ফুলের মতো শুভ্র অন্ন রকাবে সাজিয়ে পরীরা যখন পরিবেশন করে, সেটা আদৌ সুলতানকে না আপনাকে– সে তখন গুলিয়ে যায়। সুন্দরীরা পরিবেশন করে বিবিধ সুগন্ধী ব্যঞ্জন, পানি আর পান। যে সুগন্ধ চন্দনের। কস্তুরীর। শুভ্র অ্যাম্বারগ্রিসের। গোলাপজলের। বলছে নেমতনামা। পরিমাণও বলে দিচ্ছে। দু-দিরাম করে নিতে হবে প্রতিটি উপকরণ। এক দিরাম চার গ্রামের মতো। চাইলে অন্য সুগন্ধি মেশানোয় আপত্তি নেই। পরিমাণ ওই একই। খোয়াব ভাঙলে নিজের হেঁশেলেও ট্রাই করে দেখতে পারেন। আপনার হাতে তৈরি ব্যঞ্জন আর পানের, সেই সঙ্গে পানির স্বর্গীয় সুবাসে আমোদিত হয়ে উঠবে চারপাশ। আপনার মন তো নিশ্চয়ই।
আর যদি নিজেকে দীর্ঘক্ষণ ধরে সুরভিত রাখতে হয়? এরও নিদান দিচ্ছে নেমতনামা। বলছে সেক্ষেত্রে পারফিউম লাগাতে হবে শরীরের বিভিন্ন খাঁজে। জয়েন্টে। আর হাত ধুতে হবে গোলাপজল দিয়ে। কাপড় এবং কেশ সুগন্ধিত রাখার প্রক্রিয়াও বাদ যায়নি। আলাদা উল্লেখ রয়েছে এর। আর হ্যাঁ, বাতলে দেওয়া হয়েছে দিনভর ব্যাঙ্কোয়েট হল সুবাসিত রাখার তরিখাও। বাতলে দেওয়া হয়েছে পারফিউম তৈরির প্রিপারেশন। এক নয়, একাধিক। গিয়াৎ শাহির পসন্দিতা সুগন্ধিরও রয়েছে উল্লেখ। কী দিয়ে তৈরি হত সেকালের পারফিউম? জানার কৌতূহল? শুনুন তাহলে। খুশবুদার ঘাস থেকে ফুল, কস্তুরী, চন্দন, অ্যাম্বারগ্রিস, কর্পূর, গোলাপজল– সেই সঙ্গে ধূপ, জাফরান, কমলার খোসা, মধু, লবঙ্গ তেল– প্রাকৃতিক সুগন্ধে ভরপুর প্রায় কোনো জিনিসই বাদ যায়নি। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আখের গাঁট, সুগন্ধী শামুকের মতো উপকরণও। সত্যি বলতে নেমতনামার এই তালিকা সহজে ফুরোবার নয়।
আর সেক্স-মেডিসিন? এর প্রতিটি প্রিপারেশনের শেষেই রয়েছে এই দাবি, ‘বুস্ট ইয়োর সেক্সুয়াল স্টেমিনা উইথ দিস পিলস’ কিংবা ‘গেট হার্ডার, গেট স্ট্রঙ্গার, গেট বেটার উইথ দিস পিলস্’। ঠিক এই ভাষায় নয় হয়ত, কিন্তু বক্তব্য ওই একই। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের সেই বিখ্যাত রেসিপির শেষেও ছিল এমনি বক্তব্য– ‘ইট ওয়ান পেলেট ডেইলি, দ্য সিমেন ফ্লোওস্’।[vi] এর উপকরণও সহজলভ্য। চাই জয়িত্রি, লবঙ্গ, পোস্ত, জাফরান, যুঁই ফুল আর সেলারির বীজ। সব পাঁচ দিরাম করে। এই সবকিছুর একটা পেস্ট তৈরি করে মধুর সঙ্গে মিশিয়ে বড়ি তৈরি করে রোজ একটা বড়ি পানের সঙ্গে খেলেই মুশকিল আসান।
এবার সুপারফুড ফর সেক্স ড্রাইভ : দশ সের খোরাসানি সাদা পেঁয়াজ রিঙের আকারে কেটে রাখুন। গরম ঘিতে সোনালি করে ভাজার পর এতে দিন আগে থেকে ফ্রাই করা এক ভরন্ত-যৌবনের পায়রা। সঙ্গে এক পাউন্ড লাল বিন আর ছোলা। বিন-ছোলা নরম হয়ে এলে এর সঙ্গে মেশান এক দিরাম দারচিনি, আধা দিরাম গ্যালিন্গেল আর শুকনো রুটির টুকরো। ছোলা-বিন-মাংস গলে পেস্টের মতো হয়ে এলে আঁচ থেকে নামিয়ে বারকোশে ত্রিভুজ আকারে সাজিয়ে স্বর্ণপল্লব দিয়ে গার্নিশ করুন। নেমতনামা অনুযায়ী এ হচ্ছে ‘ভাঙরা’ পদ্ধতি। তন্দুরি রুটি আর চিকেন স্যুপের সঙ্গে খেতে হয় এই খাবার। গিয়াৎ শাহি বলছেন, এ হচ্ছে এমন খাবার যা ‘ইন্ক্রিস দ্য ফ্লো অফ সিমেন অ্যান্ড স্ট্রেংদেন সেক্সুয়াল ডেজায়ার।’[vii]
আরও চাই? তবে এবার পিল কিংবা খাবার নয়, প্রলেপের রেসিপি। এর জন্য চাই গরু আর ভেড়ার দুধ। সঙ্গে তাজা মাখন, ঘি (অবশ্যই গরুর দুধের) এবং মধু। সব একসঙ্গে ভালো করে মিক্স করতে হবে। এবার এক এক করে মেশাতে হবে এলাচ, খেজুর, চিরঞ্জি, আমলা, পোস্ত, লবঙ্গ, ভাজা ছোলা, খেজুর-চিনি, বড় গোল মরিচ, পাইন-নাট্স, শুকনো আদা, ছোলা, আমন্ড, ডুমুর, হরিতকী, অকরকরা, কিসমিসের পেস্ট। যৌনাঙ্গে এই মিশ্রণের প্রলেপ লাগালেই ম্যাজিক। ‘ইট মেক্স সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স ভেরি প্লেসারেবল্ অ্যান্ড কমফোর্টেবল্’– গিয়াৎ শাহির দাবি।[viii]
এমন অসংখ্য সেক্স-মেডিসিনের প্রিপারেশন পাবেন নেমতনামায়। পাবেন অন্যান্য ওষুধের প্রিপারেশনও। কাঠফাটা রোদ্দুরে বেরিয়ে তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে? বুকে ব্যথা? শিকারে বেরিয়ে গরমে হাঁসফাঁস? ঘোড়ায় চড়ে ক্লান্ত? কিংবা পিত্ত পড়ে গেছে? সান-স্ট্রোক? নিদান দেওয়া হয়েছে এরও। বলা হচ্ছে, যতরকম ফুল আর ফল সম্ভব রোগীর বিছানায় জড়ো করুন। হাস্য-পরিহাস প্রিয় কোনো রসিক ব্যক্তিকে ধরে-বেঁধে নিয়ে আসুন। সেই মুহূর্তে রোগীর কাছে বরস্বরূপ এই লোকটির সঙ্গ। রোগীকে শসা, ছোটো খিরা, বুনো ডুমুর দিন। সঙ্গে পারফিউম। রোগীর পাশে ওয়াটার হুইল চালিয়ে এর ওপর জল ছড়িয়ে দিন। গোলাপজলে পোড়া কর্পূর আর শসার পাতা মিশিয়ে রোগীর গায়ে মাখুন। ভেজা কাপড় দিয়ে বারবার শরীর মুছে দিন। জল ভর্তি পাত্রে ছিদ্র করে শাওয়ারের মতো ওপরে ঝুলিয়ে দিন। বিছানার চাদর শরীর থেকে… (এরপর কিছু লেখা নষ্ট) মিহি লিনেনের জামা পরিয়ে রাখুন। গোলাপজল, কর্পূর, চন্দনে ভিজিয়ে জলপট্টি দিন চোখে। বড় একটা চাদর এই মিশ্রণে ভিজিয়ে রোগীর মাথার ওপর ঝাড়তে থাকুন। মুক্তোর চাদর দিয়ে জড়িয়ে রাখুন রোগীর মাথা-বুক-চোখ। ধাতুর থালা কিংবা বারকোশ দিয়ে হাওয়া দিতে হবে রোগীকে। সেই সঙ্গে ভেজা মসলিনের চাদর দিয়ে ব্যজন। ঠাণ্ডা পানীয়-খাবার খাওয়াতে হবে। জুঁইফুল বরফ ঠাণ্ডা করে রাখতে হবে চোখের ওপর। পাঠের বাকি অংশ নষ্ট।
এ তো গেলো সানস্ট্রোকের কথা। আর যদি কোনো হারেমসুন্দরী গরমে অজ্ঞান হয়? নিদান রয়েছে এরও। ঘুম নেই চোখে? নিদ্রাকামী পুরুষকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে সুমধুরভাষিণীর সান্নিধ্য গ্রহণের। নেপথ্যে চলবে সরোদ। ফুল আর ফলে সুরভিত থাকবে শয্যাগৃহ। পুরুষটির ঠোঁটের ওপর নেমে আসবে ভেজা নরম ওষ্ঠাধরের স্পর্শ। এতেই ভাঙবে নিদ্রাদেবীর জড়তা। আশ্রয় নেবেন তিনি সেই পুরুষ-নয়নে।
রয়েছে এমন হাজারো নিদান। এবং খানাপিনা-আমোদ-উল্লাস-প্রাচুর্যের বর্ণনা। সংস্কৃত ঘরানার আখ্যানও। নেমতনামা আমাদের তৃপ্ত করে। ভিনদেশি এক ঘরানার তয়-তরিখা-তহ্জিব আত্মস্থ করে ভারতীয় সংস্কৃতিকে। সেই মিশ্রণ রুচিশীল। স্নিগ্ধ। সুন্দর। আমরা মুগ্ধ হই। এর পরিচয়-লাভে। আমরা আনত হই। স্তুতি ও শ্রদ্ধায়।
[i] Mahomed Kasim Ferishta, History of the Rise of the Mohamedan Power in India, Till the Year A.D. 1612, Translated by John Briggs, Vol. IV, Oriental Books Reprint Corporation, New Delhi, P. 143
[ii] Ibid, p. 143
[iii] The Nimatnama Manuscript of the Sultans of Mandu, The Sultan’s Book of Delights, Translated by Norah M. Titley, Routeledge Curzon, London and New York, 2005, Introduction page
[iv] Ruchika Sharma, Thinker, tailor, spy: The extraordinary women of Ghiyas-ud-din Khalji’s harem, scroll.in, Mar 22, 2017
[v] The Ni’matnama, introduction page
[vi] The Ni’matnama, p. 33
[vii] The Ni’matnama, p. 55
[viii] The Ni’matnama, p. 34