দাদার খাদ্যঃ ঘনাদা ও তার রকমারি ভোজনবিলাস
Volume 4 | Issue 6 [October 2024]

দাদার খাদ্যঃ ঘনাদা ও তার রকমারি ভোজনবিলাস <br>Volume 4 | Issue 6 [October 2024]

দাদার খাদ্যঃ ঘনাদা ও তার রকমারি ভোজনবিলাস

—ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল

Volume 4 | Issue 6 [October 2024]

ছবি – সামিম আকতার শেখ

গৌরচন্দ্রিকাঃ

প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন একাধারে শিশুসাহিত্যিক এবং সিনেমা নির্মাতা। আবার বাংলা কবিতার এবং উপন্যাসের কিছু কিছু ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। “ঘনাদা”, “পরাশর বর্মা”, “মেজোকর্তা”, “মামাবাবু” ইত্যাদি বহু অবিস্মরণীয় চরিত্রের সিরিজ তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। এহেন বহুমুখী প্রতিভার মানুষের কলম থেকে বেরোনো ঘনাদার গল্প যে ব্যতিক্রমী হবে, সেটা বলাই বাহুল্য। বাংলায় সাধারণত বিজ্ঞান বিষয়ক কাহিনী খুব একটা মূল সাহিত্যের আঙিনায় কল্কে পায় না। বাংলার বেশিরভাগ জনপ্রিয় উপন্যাস বা গল্পের মূল প্রতিপাদ্য হল সেই মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন, রাজনীতি বা অলৌকিক ঘটনা। আধুনিক বিজ্ঞানের রকমারি চমক বা অগ্রগতি সাধারণত এইসব মূলধারার সাহিত্যে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিদেশে যেমন বিজ্ঞানকেই নায়ক বানিয়ে প্রচুর জনপ্রিয় সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে (যেমন মাইকেল ক্রাইটনের জুরাসিক পার্ক), এবং বিজ্ঞানের আবিষ্কার কিভাবে মানুষের জীবনকে সুন্দর করে তুলেছে সেই নিয়ে কাহিনী নির্মিত হয়েছে, সেই ধারা বাংলায় একদম নেই। সেই প্রেক্ষাপটে প্রেমেন্দ্র মিত্র চেষ্টা করেছিলেন ঘনাদার গল্পের মাধ্যমে আমাদের সমাজে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার বিষয়ে কৌতূহল জাগ্রত করতে।  অবশ্য শুধু বিজ্ঞান নয়, ইতিহাস, ভূগোল এবং জীববৈচিত্র্য নিয়েও নানা তথ্যের আকর রয়েছে এই সব গল্পে।

ঘনাদাঃ এক আশ্চর্য চরিত্র

ঘনাদা চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যে এক অদ্বিতীয় সৃষ্টি। এর গুরুত্ব আরও বেশি এই কারণে যে ঘনাদার মত মানুষ এখন আর পাওয়া যায় না। অর্থাৎ, একজন অভিভাবকপ্রতীম বড়দার মত মানুষ যিনি বাড়িতে সবসময়ে থাকেন এবং গল্প করেই লোকের সারাদিনের সময়টা ভরিয়ে রাখেন, এরকম চরিত্র বাস্তবে আর নেই। এই ধরণের লোক একটি বিশেষ সময়ের প্রতীক, যে সময়কাল এখন স্মৃতির গর্ভে হারিয়ে গেছে।

আজকাল বেকার হয়ে আর কেউ বসে থাকে না। গত তিরিশ বছরে, বাজার অর্থনীতির আগমনের পর, দেশে কাজের ক্ষেত্র অনেক বেড়েছে এবং সবাইকেই একটা বয়সের পর কাজ করতে হয়। ঘনাদার মেসের ভাড়া যেমন বছরের পর বছর অন্যেরা দিয়ে দিত, এবং কোনও কাজ না করা সত্ত্বেও যে অন্যরা তাঁর রকমারি খাবারের বায়না সহ্য করত, সেই দিন এখন আর নেই। সারাদিন ঘরে বসে থাকে এবং বিকালে বেড়াতে বেরিয়ে সান্ধ্যভ্রমণের আড্ডার পর জলখাবার খেতে খেতে মেসের বন্ধুদের সাথে স্রেফ গল্প করেই দিন কাটিয়ে দেয়, এরকম লোক এখন অচল। তাছাড়া এই ইন্টারনেটের যুগে আজগুবি গল্প শুনলে শিশু থেকে প্রবীণঃ কেউ মেনে নেবে না। একবার গুগল সার্চ দিলেই সত্যি-মিথ্যে ধরা পড়ে যাবে এবং তারপর যে শুধু সেই লোককে টিটকিরি শুনতে হবে, তাই নয়; সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোল-ও হতে হবে। ফলে এরকম “গুল মারা” বেকার চরিত্র পৃথিবী থেকে মুছে গেছে।

কিন্তু এরকম চরিত্র কী খারাপ? বেকার হলেই কী সেই ব্যক্তি জীবনে ব্যর্থ? আজকাল এই অতি-বাস্তবতার যুগে এরকম মাঝে মাঝে কল্পনার জগতে নিয়ে যাওয়ার মানুষ থাকলে মন্দ কী? আর ঘনাদার গল্পগুলির বৈশিষ্ট্য হল যে কল্পনা হলেও এগুলি কিন্তু আসল বৈজ্ঞানিক এবং ঐতিহাসিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই লেখা। ফলে এইসব গল্প পড়লে শুধু যে বিনোদন হয়, তা নয়; সেই সাথে বাস্তব জ্ঞানও আহরণ করা যায়। তবে এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় এইসব গল্পের অনুপুঙ্খ বিবরণ নয়, বরং এইসব গল্পে বর্ণিত খাদ্যের সমাহার।

বাঙালির খাদ্যরসিক দুই দাদা

প্রায় একই সময়ে লেখা বাংলা কিশোরসাহিত্যের দুই জনপ্রিয় সিরিজ হল টেনিদা এবং ঘনাদা। এই দুই সিরিজের প্রোটাগনিস্ট-ই খেতে খুব ভালোবাসেন।

টেনিদার গল্পে যেমন অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল নানারকম খাবার, এই ঘনাদার গল্পেও তাই। তবে দুটি গল্প সিরিজের খাবারের বর্ণনায় পার্থক্য আছে। টেনিদার গল্পে খাবার এসেছে গল্পের ফাঁকে ফাঁকেই। সবকটি চরিত্রের যেন সবসময়েই মুখ চলছেঃ সে ঝালমুড়ি হোক, বা চকলেট বা চানাচুর। রাস্তার ফেরিওয়ালার খাবার, রেস্তোরাঁর খাবার, বাড়ির রান্না খাবার, এমনকি তালের বড়া ভাজা—সব কিছুই সেই গল্পগুলিতে এসেছে কাহিনীর ফাঁকে। টেনিদার গল্পে চরিত্রদের খাবার নিয়ে উন্নাসিকতা নেই। পেটে কিছু পড়লেই হল। টেনিদা তো রসগোল্লার হাড়ির রস অবধি ছাড়ত না, সেই রসে গোটাকয়েক পিঁপড়ে থাকলেও! এক কথায়, এই চরিত্রগুলি হ্যাংলা।

কিন্তু ঘনাদার গল্পে খাবার একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। এখানে খাবারের বর্ণনা “ক্যাজুয়াল” নয়। সেই ভোজের জন্য অনেক আগে থেকে আয়োজন লাগে, সেই খাবারের উপাদান সংগ্রহ করতে দূরদূরান্তের বাজারে যেতে হয়। সেই খাবার বানানোর জন্য খোঁজ রাখতে হয় যে শিয়ালদহের বাজারে নতুন মাছ উঠেছে কিনা। সেই খাবারের জন্য আগে থেকে অর্ডার দিতে হয়। সেই খাবার বিশেষ ভাবে পরিবেশন করতে হয়। সেই খাবার যখন ঘনাদা গ্রহণ করছেন, তখন সেই দৃশ্য নিস্তব্ধ হয়ে দেখতে হয়; ঘনাদার খাওয়ার সময়ে বেশি কথা বললেই তাঁর মুড নষ্ট হবে। অবশ্যই এই খাবার জোগাড় হয় মেসের অন্য বোর্ডারদের পয়সায়। ঘনাদাকে খেতে দিয়েই সেই মেসের অধিবাসীরা ধন্য। ইংরেজিতে একটা কথা আছেঃ segue । ঘনাদার গল্পে খাবার হল সেই segue। এই ভোজ সঠিকভাবে হলে তবেই খুলবে গল্পের জগতের গোপন দরজা। আসুন, এবার আমরা সেই মহাভোজের দিকে একটু নজর দিয়ে দেখি।

ঘনাদার খাবারের বিলাস

ঘনাদার প্রথম গল্প “মশা”। এটি প্রকাশিত হয়েছিল স্বাধীনতারও দুই বছর আগে। তখন দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রত্যেক বছর নতুন নতুন নাম দিয়ে পূজাসংখ্যা প্রকাশিত হত। সেইরকম ১৯৪৫ সালের পূজাসংখ্যা, “আলপনা” তে প্রকাশিত হয়েছিল “মশা”। এই গল্পে অবশ্য খাবারের বর্ণনা সেরকম কিছু নেই। প্রথম দিকের চার-পাঁচটা গল্পে ঘনাদার ধার করে সিগারেট খাওয়ার গল্প ছাড়া সেরকম কিছুই বলা নেই। খাবার নিয়ে প্রথম বর্ণনা শুরু হল “মাছ” গল্পে (১৯৪৯)। এই গল্প শুরুই হচ্ছে এক দুপুরের “ফিস্ট” নিয়ে। সেখানে জানা গেল যে ঘনাদা মাগুর মাছের ঝোল খান না। বরং তাঁর চাই মাংসের কালিয়া। (এবং সেটা পেট খারাপ হলেও!) এটাও জানা গেল যে তিনি ভোজন রসিক। পর পর দু-বাটি মাংসের কালিয়া (অবশ্যই পরের পয়সায়) না খেয়ে তিনি মুখ তোলার ফুরসত পান না। তার পর অবশ্য দই, সন্দেশ, পান্তুয়া ইত্যাদিও চাই। সেই শুরু হল ঘনাদার খাবারের বিবরণ। অবশ্য এর পরে আবার বেশ কয়েকটা গল্পে খাবার বর্ণনা প্রায় কিছুই নেই। এভাবেই শেষ হয়েছে প্রথম গল্পসমগ্র।

দ্বিতীয় গল্পসংগ্রহ, “অদ্বিতীয় ঘনাদা” তে আবার শুরু হয়েছে খাবারের গল্প। এবার অবশ্য খাবার ব্যাপারটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ঘনাদা খাদ্যকে এবার ব্যাবহার করছেন “bargaining chip” হিসাবে। “ফুটো” গল্পে (১৯৫৪) দেখা যাচ্ছে যে ঘনাদা মেস ছেড়ে চলে যেতে চান এবং তাঁকে নিরস্ত করার জন্য অন্যরা জানাচ্ছে যে সেদিন মেসে গঙ্গার ইলিশ এসেছে। এর পরে তাঁকে প্রশ্ন করছে তাঁর ভক্তরা যে তিনি কিভাবে রান্না করে ইলিশ মাছ খাওয়া পছন্দ করেন।

খাদ্যের ক্রমবিবর্তন

এরপর যত নতুন ঘনাদার গল্প এসেছে, ততই দেখা গেছে যে একটা প্যাটার্ন আছে। অর্থাৎ বেশিরভাগ সময়েই গল্পের শুরুতে দেখা যাবে যে ঘনাদা কোনও কারণে রেগে আছেন বা নিজের ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে বসে আছেন। বা কোনও একদিন খাবার সময়ে কিছু একটা গণ্ডগোল হওয়ার পর থেকেই তাঁর মুড অফ। সোজা কথায় এককালে যাকে বলা হত “গোঁসা করে থাকা”। এদিকে তাঁর ভক্তরা নতুন গুলগল্প শুনতে না পেয়ে উতলা হয়ে উঠেছে। তারপর একদিন মাহেন্দ্রক্ষণে বিশেষ কোন খাবারের ঘুষ দিয়ে তাঁর মুখ আবার খুলেছে এবং সেই মুখনিঃসৃত কাহিনীর স্পর্শে সেই মেসে আবার প্রাণ ফিরে এসেছে।

বেশিরভাগ সময়েই এভাবেই গল্প শুরু হয়েছে। যেমন “দাঁত” গল্পে (১৯৫৫) ফিশ ক্রোকেট বা “সুতো” গল্পের (১৯৫৮) কবিরাজি কাটলেট (পর পর চারটে!)। যত দিন গেছে, ততই খাবারের ভ্যারাইটী বেড়েছে। প্রথম দিককার গল্পে যেমন মেসে রান্না করা ডালপুরি, ইলিশ বা মাংসের ঝোলেই বর্ণনা শেষ হয়েছে, পরের দিকের গল্পে সেই রেসিপিতেই লেগেছে দেশ-বিদেশের নানা খাবারের ছোঁয়া। ফিশ ক্রোকেট আগেই বললাম। এটা ফরাসী খাবার। তবে বাঙালি খাবার অবশ্যই রয়েছে মধ্যমণি হয়ে। যেমন বর্ষার দিনে খিচুড়ির সাথে চাই ইলিশ। “ঢিল” গল্পে (১৯৬০) সেই ইলিশের বদলে পার্শে মাছ আসায় ঘনাদার মুড নষ্ট হয়েছিল। আবার এই লোকই বিকেলের তেলেভাজার গন্ধে থাকতে না পেরে আড্ডাঘরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং আগের সব রাগ ভুলে গল্প শুরু করেছিলেন; অবশ্যই মুখ চালাতে চালাতে।

ঘনাদা যে পেটুক সেটা ওনার নানা কাজকর্মেই স্পষ্ট। একদম প্রথম দিকের “হাঁস” গল্পে (১৯৫৭) উনি বাপি দত্তের বাড়ির জন্য কিনে রাখা হাঁস মাংসের লোভে না বলেই রান্না করে ফেলেছিলেন। তারপর সেই বাপি দত্ত রেগে গেলে তাঁকে হাঁসের পেটে অমূল্য রতন আছে, এই বলে শান্ত করেছিলেন। “কেঁচো” গল্পে (১৯৬১) জানা যায় যে উনি মাঝে মাঝে ভেটকি মাছের “ক্রোকেট” খাওয়ার আবদার করতেন। “পৃথিবী বাড়ল না কেন?” গল্পে উনি নিজের প্লেট শেষ করে তারপর “দুর্বাসা মুনি”র ছদ্মবেশ ধরা ব্যক্তির হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় প্লেট ফিশ রোল নিমেষে শেষ করেছিলেন। লেখকের বর্ণনা অনুযায়ী, ঘনাদা acute angle-এ খাওয়া শুরু করতেন আর শেষ করতেন obtuse angle-এ। সেই মেসবাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সপ্তাহান্তের “ফিস্ট”। ঘনাদা এই ফিস্টের বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন এবং সারা সপ্তাহ ধরে আবদার করতেন। ওনার আবদার যে শুধু খাবারের নামেই সীমাবদ্ধ থাকত, তা নয়। তার ওপর কোথা থেকে বাজার করে সেই রান্না হলে সবচেয়ে ভালো স্বাদ হবে, সেই বিষয়েও ওনার ব্যক্তিগত মতামত থাকত। যেমন বিরিয়ানি হলে মাংস আনতে হবে একটি বিশেষ বাজারের বিশেষ দোকান থেকে। নইলে সেই বিরিয়ানি ওনার মুখে রুচবে না। ঘনাদা নিজে কোনও কাজ করতেন না। কিন্তু মেসে যারা চাকরি করত, তাদের যেদিন ছুটি থাকত, সেইদিন “ছুটির দুপুর” এর স্পেশ্যাল খাবার কিন্তু ঘনাদার কথা ভেবেই রান্না হত। “তেল দেবেন ঘনাদা” গল্পে যেমন বর্ণনা আছে যে ছুটির দিনে রান্না হচ্ছে চিতল মাছের ধোঁকা। আবার কখনও রাস্তায় বেড়াতে বেরিয়ে কোনও খাবার চোখে লেগে গেলে উনি অর্ডার দিয়ে চলে আসতেন। যেমন “মান্ধাতার টোপ ও ঘনাদা” গল্পে হিং কচুরি। সেই খাবার যখন আড্ডাঘরে উপস্থিত হবে, তখন অবশ্যই তার দাম মেটাবে ঘনাদার একনিষ্ঠ ভক্তের দল। আবার পেটুক শুধু নয়, উনি কিন্তু সত্যিকারের খাদ্যরসিক। যেমন “ঘনাদার চিংড়ি বৃত্তান্ত” গল্পে উনি বিশেষ দোকান থেকে আনা কচুরি দেখে এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে সঙ্গে সঙ্গে তার নতুন নামকরণ করেছিলেন “রাধাচুরি”ঃ মানে রাধাবল্লভী আর কচুরির মিশ্রণ।

তবে মেসের ভক্তরা যেমন খাবার দিয়ে ঘনাদাকে কাবু করার চেষ্টা করেছে, তেমন ঘনাদাও অনেক সময়ে এইসব খাবার ব্যবহার করেছেন দর কষাকষির জন্য। এর জন্য কখনও বাদশাহী সিঙ্গারা ত্যাগ করেছেন তো কখনও আইসক্রিম বা রাবড়ি। আবার সেই ব্ল্যাক মার্কেটের যুগে বহু কষ্ট করে খুঁজে আনা ইলিশ মাছের নিন্দাও তিনি করেছেন যে সেটা গঙ্গার ইলিশ নয়, রূপনারায়নের ইলিশ, এই বলে।  অবশ্য তাই বলে সেই ইলিশের রকমারি পদের স্বাদ নিতে তিনি ছাড়েননি। এক রাত্রেই তিনি ইলিশ ভাজা থেকে ইলিশ ভাতে—সবরকম পদ খেয়েছেন এই নিন্দা করতে করতেই (“ভাষা” গল্প, ১৯৬৬)। আবার কোনদিন স্পেশাল চপ আর মশলা মুড়ি উনি ত্যাগ করেছেন এবং প্রত্যাশামতোই তাঁর ভক্তরা তাঁকে খুশি করতে কখনও কলকাতার সেরা শিককাবাব, তো কখনও বেগুনফুলি আম এনে হাজির করেছে। “তেল” গল্পে যেমন কলকাতায় বাইরে থেকে ওনার জন্য তপসে মাছ আনানো হয়েছিল। তবে খাবার না দিলেই যে উনি মুখ বন্ধ করে রাখতেন, সবসময় সেটা কিন্তু নয়। “ঘনাদার বাঘ” গল্পে যেমন বহুপ্রতীক্ষিত শামিকাবাব এসেছিল গল্প বলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেই। সেই কারণে গল্পের স্রোতে কিন্তু ছেদ পড়েনি।

জানা যায় যে ঘনাদার স্রষ্টা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের খুব সম্ভবত শেষ বয়সে ডায়াবেটিস হয়েছিল। ফলে ওনার খাদ্যের তালিকার পরিধি অনেকটাই ছোট হয়ে গিয়েছিল এবং আগে উনি যা যা পছন্দ করতেন, সে সবকিছু থেকেই ওনার রসনা বাকি জীবন বঞ্চিত ছিল। সেই বঞ্চনার প্রতিফলন পড়েছিল এইসব গল্পে। যেসব খাবারের প্রতি ওনার আকর্ষণ ছিল, সেইসব লোভনীয় খাবার উনি ঘনাদার প্লেটে হাজির করেছিলেন।

খাওয়ার ব্যাপারে নানা খুঁটিনাটি দিকেও ঘনাদার তীক্ষ্ণ নজর। যেমন “কাঁটা” গল্পে সদ্য ভাজা মশলা পাঁপড় খাওয়ার আগে উনি জানতে চান যে সেটা কোথা থেকে আনা। পাঁপড় সেই মেসেই ভাজা হলেও ভক্তরা তাঁকে এই বলে ভুলিয়ে রাখে যে সেটা পাশের বিখ্যাত রাজস্থানী খাবারের দোকানে ভাজা। আবার খেতে বসে সবসময় ঘনাদার পাতে ভাগ হত বেশি। যেমন ফিশ রোল যদি সবার প্লেটে একটা থাকে, তবে ঘনাদার প্লেটে দুটো থাকবেই। “মঙ্গল গ্রহে ঘনাদা” গল্পে উনি গল্প শুরুর আগেই পাঁচ প্লেট মাংসের শিঙ্গাড়া সাবাড় করেছিলেন! মাঝখানে এই গল্পের আসরে মূর্তিমান তালকানার মত দেখা দিয়েছিল ধনু চৌধুরী নামক এক বোর্ডার। সে আবার ঘনাদার প্রতি অতিরিক্ত ভক্তি দেখাতে গিয়ে তাঁর সব সুস্বাদু খাবার বন্ধ করে দেওয়ার তোড়জোড় করেছিল। “ঘনাদার ধনুর্ভংগ” গল্পে রয়েছে কিভাবে এই নতুন বোর্ডার-এর ভক্তির ঠ্যালায় ঘনাদার দেড় বিঘত পরিমাণ পার্শে মাছ বা কমরেড কেবিনের কবিরাজি কাটলেট খাওয়া মাথায় উঠেছিল। যখন অন্য ভক্তরা প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখন ঘনাদা নিজেই নিজের খাদ্যবিলাসের পক্ষে বিপজ্জনক এই ব্যক্তিকে ভয় দেখিয়ে মেসছাড়া করার ব্যবস্থা করেছিলেন! ঠিক এক ভাবে, অন্য একজন নতুন বোর্ডার গুরুভোজনের পর হজমি খাওয়ার কথা বলে ঘনাদার বিরাগভজন হয়েছিল। সুতরাং, প্রায় তিন দশক জুড়ে লেখা এইসব গল্পে যে ঘনাদার খাবারের পছন্দ খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছিল, তা নয়। মোটামুটি এই সময়ে কলকাতার যে সব বিখ্যাত খাবার (বেশিরভাগ আমিষ), সেগুলোই ঘুরেফিরে এসেছে এইসব আখ্যানে। আসলে এই সময়ে কলকাতায় খুব একটা নতুন খাবার বা নতুন ব্র্যান্ড কিছুই আসেনি। ফলে এই সময়পর্বে যে বাঙালির খাদ্যরুচিতে খুব লক্ষণীয় কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল, তা নয়। এই পরিবর্তন আসতে শুরু করে নব্বই দশক থেকে। কিন্তু তখন ঘনাদার চলা থেমে গেছে। যদি ঘনাদার গল্প আজকে লেখা হত, তাহলে অবশ্যই বার্গার কিং বা টার্কিশ আইসক্রিমের কথা থাকত। কিন্তু সেই সত্তর বা আশির দশকে সেসব কোথায়?

খাবার ছাড়া ঘনাদার গল্প

তবে ভালো ভালো খাবার ছাড়া যে ঘনাদার গল্পের ঝাঁপি খুলত না, সেটা কিন্তু নয়। পরের দিকে প্রেমেন্দ্র মিত্র অন্য প্রেক্ষাপটে ঘনাদার কিছু গল্প লিখেছিলেন যেখানে শ্রোতা রবীন্দ্র সরোবরের পাশের পার্কে ঘুরতে আসা কিছু বৃদ্ধ। সেইসব গল্পে কিন্তু সরাসরি খাবারের উল্লেখ নেই। এইসব গল্পের মধ্যে রয়েছে “আগ্রা যখন টলমল” বা “দাস হলেন ঘনাদা”। এইসব গল্পে বরং ভোজনবিলাসী রামশরণবাবু খাবার ব্যাপারে গল্প করার সুযোগই পেতেন না ঘনাদার কথার তোড়ে। এই লেকের ধারের আসরে ঘনাদা কিন্তু খাবারের ঘুষ ছাড়াই অকাতরে গল্পের ঝাঁপি খুলেছেন।

খাদ্যরসিক ঘনাদার ভাগ্য ভালো ছিল যে তাঁর মেসে যে রামভুজ নামে রাঁধুনি ছিল, সে প্রায় পৃথিবীর সব ভালো খাবার বানাতে পারত। সেটা ফিশরোল হোক, বা মটনের রোগন জোশ। এতে অবশ্য একটা সুবিধা হত। ঘনাদার আবার আসর জমানোর জন্য দরকার হত গরম গরম রান্না করা খানা। মেসেই স্বয়ং “মাস্টারশেফ” হাজির থাকায় এই আবদারও সহজে মেটানো সম্ভব হত। অবশ্য সেরকম পরিস্থিতিতে বাইরে থেকে রাঁধুনি আনিয়েও ঘনাদার জন্য রান্না করানো হয়েছে। যেমন “ঘনাদা ফিরলেন” গল্পে হোটেলের শেফ আনিয়ে “স্মোকড হিলশা” রান্না করানো। এই গল্পেই ঘনাদা পাঁচ দিন একটা নিরামিষ হোটেলে লুকিয়ে ছিলেন। তারপর যখন মেসে ফিরেছিলেন, তখন সেই পাঁচদিনের নিরামিষের জ্বালা মেটাতে একসাথে সমস্ত রকম আমিষ খাবার এনে হাজির করতে হয়েছিল। আসলে বোঝা যায় যে মেসের “ফিস্ট” এর বর্ণনা একধরণের wishful thinking। কলকাতার একটা সাধারণ মেসে দৈনিক খাবারের মান কেমন হয়, সবাই জানেন। সেখানে তপসে মাছ ভাজাও হয়না, পোলাও-ও হয়না। সেইজন্যই বোধহয় প্রেমেন্দ্র মিত্র এইসব গল্পে এক অসাধারণ মেসের বর্ণনা তৈরি করেছেন।

শেষ কথা

বাঙালির খাবারের প্রতি দুর্বলতার কথা সর্বজনবিদিত। নিজের ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন বাঙালির চাই, সেরকম চাই নতুন দেশের নতুন খাবার। ঘনাদা বাঙালির সেই ফুডি স্পিরিটকেই মাথায় করে রেখেছেন। উনি ইলিশ মাছ খাচ্ছেন, আবার স্যান্ডউইচ খেতেও আপত্তি নেই। অবশ্য সেই স্যান্ডউইচে শুধু সবজি (ঘনাদার ভাষায় বোটানিক্যাল গার্ডেন) না থেকে সসেজ বা চিকেন থাকলেই ভালো হয়। তেলেভাজাও চাই, আবার বিরিয়ানিও চাই। মিষ্টিও বাদ নেই। একবার ভক্তরা ওনাকে উপহার দিয়েছিল “এক বারকোশ প্রমাণ নরম পাকের কাঁচাগোল্লা”। প্রেমেন্দ্র মিত্র এইসব গল্পে বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন নিপুণভাবে। আজকের এই ক্যালোরি মেপে খাওয়ার যুগে এইরকম খাদ্যরসিক লোক বিরল। সেই চপ-কাটলেট-মিষ্টি-বিরিয়ানি এইসবই এখনও আছে। হয়ত বিশ্বায়নের ফলে খাদ্যের ভ্যারাইটি আরও বেড়েছে। কিন্তু এরকম খাদ্যরসিক আর আছে কী?

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

oneating-border
Scroll to Top
  • The views expressed through this site are those of the individual authors writing in their individual capacities only and not those of the owners and/or editors of this website. All liability with respect to actions taken or not taken based on the contents of this site are hereby expressly disclaimed. The content on this posting is provided “as is”; no representations are made that the content is error-free.

    The visitor/reader/contributor of this website acknowledges and agrees that when he/she reads or posts content on this website or views content provided by others, they are doing so at their own discretion and risk, including any reliance on the accuracy or completeness of that content. The visitor/contributor further acknowledges and agrees that the views expressed by them in their content do not necessarily reflect the views of oneating.in, and we do not support or endorse any user content. The visitor/contributor acknowledges that oneating.in has no obligation to pre-screen, monitor, review, or edit any content posted by the visitor/contributor and other users of this Site.

    No content/artwork/image used in this site may be reproduced in any form without obtaining explicit prior permission from the owners of oneating.in.