‘হাট’: এক বাঙালি মুসলমানের স্মৃতিকথা।
লেখা ও ছবি – সামিম আকতার শেখ
Volume 3 | Issue 10 [February 2024]
এবার যখন জন্মদিনে জীবনের 24 টা বছর পূর্ণ করলাম তখন হায়দ্রাবাদ থেকে ছুটি পেয়ে বাড়ি এসেছিলাম কিছুদিন কাটাতে । জন্মদিনের ঠিক আগের দিন গায়ে একটু হাওয়া লাগাতে ঢুঁ মেরে আসলাম সকাল সকাল হাটে। হাট, আমাদের গ্রামের বৃহস্পতিবারের হাট । নদীয়া জেলার এক কোনায় এই গ্রামের একটি প্রান্ত মুসলিম জনবহুল, যাহা বটতলা নামে পরিচিত। ছোটবেলা থেকে এবেলা , জীবনে অনেক কিছু পাল্টেছে , কিন্তু কিছু জিনিস যদি কনস্ট্যান্ট থেকে গেছে সেটা হলো গ্রামের এই হাট।
হাট , হাট হলো গ্রামের একটি সাপ্তাহিক বাজার , শুধু সব্জি ফল আলুমুলোর বাজার না । বাজার মানে আগা থেকে মাথা আপাদমস্তক বাজার। সব্জি ফল মূল থেকে শুরু করে গরু বাছুর ছাগল এমনকি কখনো কখনো তো মানুষ অব্দি বিক্রি হয়ে গেছে এই বাজারে । যায় হোক সে অন্য ঘটনা ।
গ্রামের এই হাট যে শুধু আমাদের গ্রামের হাট তাই না , এই হাট এর অপেক্ষায় থাকে আমাদের গ্রামের আসে পাশের ছোট ছোট গ্রাম গুলোও। দ্বীপচন্দ্র পুর থেকে আদর আলী আসত গামছা বেচতে , নবদ্বীপের গামছা । সাইকেলের দুই হ্যান্ডেলে ঝুলত বড়ো বড়ো ব্যাগ তাতে থাকত ঢের গামছা। টকটকে লাল কাপড়ের উপর সুন্দর সুন্দর সবুজ রঙের ডোরা কাটা দাগ। আদর আলীর থেকে কেনা গামছা আশলে ঘুরে বেড়ায় সারা হাটে। কারোর গলায় ঝুলে ঘুরে বেড়ায় সে গামছা নয়ত কারোর কোমরে নয়ত ঘাড়ে।
আমাদের এই হাট টা মূলত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত শুরুতেই ঢোকার মুখে থাকত সবরকম জামাকাপড় এর দোকান , ছোট ছোট বাঁশের খোপে ত্রিপল টাঙিয়ে বসত দোকান গুলো । আমার মনে আছে সপ্তাহের অন্য দিন গুলো এই বাঁশের খোপ গুলো ধরে ঝুলতাম আর বাঁদর বাঁদর খেলতাম । বিকেল বেলায় এই খুপচি গুলোতে তাস খেলার আসর বসত , গাঁয়ের সব কাকা বুড়ো রা ভিড় করত। তাসের আসরের মাঝে আসতে থাকত শিবুর দোকানের সিঙ্গারা আর স্বপন কাকার দোকান থেকে মুড়ি , মুড়ির উপর চানাচুর আর অল্প করে কাঁচা সর্ষের তেল , পেয়াঁজ আর কাঁচা লঙ্কা টা আলাদা করেই থাকত, সেটা কুচোন হতোনা ।
যাই হোক, হাটের শুরুতে কাপড়ের দোকান গুলো শেষ হলে এক কোনায় লাগত মশারির দোকান আর একটু ভিতরের দিকে ছাতা সারানোর দোকান । আমার আব্বা ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার । হাটের পাশে এক কোনায় ছিল আব্বার চেম্বার , এখনো মনে আছে বৃহস্পতিবার আব্বা সারাদিন চেম্বার খোলা রাখত , আর আমাদের চেম্বারের বাইরের শেডের নীচে বসতেন এক মশারী কাকু , কাকুর নাম আমি কোনদিন জিজ্ঞাসা করিনি । বর্তমানে আব্বার চেম্বারটি অন্য কাউকে ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বসেছে আজ এক এলাহী মিষ্টির দোকান। এখন আর বৃহস্পতিবার ওই মশারী কাকুটি শেডের নীচে বসে না। তাকে তারপর আর কোনদিন দেখিনি হাটে।
এরপরে বসত টর্চ লাইট আর ছাতা সারানোর দোকান, এই দোকান গুলি এখন রীতিমত কমে এসেছে । আগে ছিল লাইন দিয়ে পাঁচজন এখন সেটা কমে গিয়ে মটে একজন। আমার এখনো মনে আছে , গ্রামের পাশেই বেথুয়াডহরী থেকে এক বুড়ো আসতেন ছাতা সারাতে , আমার মেজআব্বার গরুর ব্যবসা তখন খুব তুঙ্গে , প্রতি হাটে ভালোই গরু কেনা বেচা হচ্ছে । এরকম সময়ই একদিন শুনি ওই বুড়ো ছাতাওয়ালা নাকি আমার দাদা মানে মেজ আব্বার বড়ো ছেলের (বচ্চন দা) জন্য নিয়ে এসেছেন এক সম্বন্ধ । তাদের গ্রামেরই এক মেয়ে । একথা শুনতে না শুনতেই একদিন দেখি দেখা সাক্ষৎ সব পাকা হয়ে উঠল বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। তখন আমি ক্লাস ফোর ধেই ধেই করে গেলাম দাদার বড়যাত্রীতে , বেথুয়াডহরীর পাশে এক ছোট্ট গ্রাম , নাম ‘সলি’ , এখানেই আমি প্রথম বার খেয়েছিলাম গোলাপি রঙের রসগোল্লা , যা ছিল আমার জন্য পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। তখন খুব ছোট ছিলাম তাই ছিলাম খুব কিউরিয়াস এই রসগোল্লা নিয়ে, কিন্তু কাউকে জিজ্ঞাসা করিনি এই রসগোল্লা সাদা থেকে গোলাপি হলো কি করে । এই ভাবেই আমার গ্রামের হাট বিয়ের সম্বন্ধ এনে দিয়েছে । আর আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে গোলাপি রসগোল্লার । হাটের সঙ্গেও মিষ্টান্নের একটা মধুর সম্পর্ক আমার স্মৃতি তে এখনো আঠার মত লেগে আছে ।
হাটের ঠিক মাঝখানে সমস্ত সব্জি দোকান গুলো যেখান থেকে শুরু হয়েছে ঠিক তার মাঝে কোন এক জায়গায় ত্রিপল এর খুঁটি গেড়ে জিলিপি বেচত এক ‘দাদু-দিদার’ জুটি। এখনো মনে আছে, ছোট বেলায় অদ্ভুত ভাবে দাঁড়িয়ে দেখতাম ওদের জিলিপি বানানো। দাদু ছিল সম্পুর্ন শ্যামবর্ণের রোগা একজন মানুষ তার গাল গুলো ছিল তৈলাক্ত এবং তাতে লড়াই চলত কুঁচকে যাওয়া গালের রেখার। এর থেকেও বেশি আকষর্ণীয় ছিল তার চিনির সিরা ভর্তি করাইটি । কিভাবে একটার পর একটা জিলিপির আকৃতি সৃষ্টি করত দাদু ওই কড়াইয়ের উপর। একেই বলে সৃষ্টি । আমার দেখা জীবনের প্রথম অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট। দিদা মূলত দাদু কে এসিস্ট করতেন সিঙ্গারা এবং পেঁয়াজি ভাজার জন্য। দাদুর দোকানে জিলিপি ছাড়াও আরো তিনটে স্পেশাল আইটেম ছিল। সিঙ্গারা , পেঁয়াজি এবং গুড়ের গজা। কিন্তু আমার বরাবরই প্রিয় ছিল জিলিপি। আমার কাকার ছেলে কেলুর প্রিয় ছিল গুড়ের গজা , তিন টাকা হাতে থাকলে দুজনে আধা আধা পয়সা শেয়ার করে কিনতাম জিলিপি আর গুড়ের গজা । সারা ভারত ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ধরনের জিলিপি খেয়েছি কিন্তু আজো দাদুর দোকানের ওই জিলিপিকে টক্কর কোন জিলিপি দিতে পারেনি। এখনো মনে আছে আগে যখন বাবার হাত ধরে হাট করতে যেতাম তখন হাট শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাবা কিনতেন জিলিপি । সেই অভ্যাস আমাকেও ধরে নেয়, যখন নিজে নিজে একটু হাট করা শিখছি তখন মা আমাকে দিত একটা পঞ্চাশ টাকার নোট এবং আমার কাজ ছিল ওই পঞ্চাশ টাকার মধ্যে সমস্ত কিছু কিনতে এবং তার থেকে 5 টি টাকা ধার্য্য হত আমার বকশিশ । এবং ওই 5 টাকায় আমি কোন ভাবনা চিন্তা না করে কিনতাম গরম গরম জিলিপি । 5 টাকায় এক ভদ্র পরিমানের জিলিপি তখন পেয়ে যেতাম । মনে আছে একবার হাট করতে গিয়ে হিসেবে একটু গড়বড় হয়ে গেছিল , ওই পাঁচটি টাকা আর বাঁচাতে পারিনি , জিলিপির দোকানে সেদিন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম , কিন্তু সেদিন আর কিছু করার ছিলনা , ছুটে বাড়ির দিকে পালিয়েছিলাম এক একটা পয়সার মূল্য সেদিন হারে হারে টের পেয়েছিলাম। আজ এতটা বছর পর পকেট ভর্তি টাকা থাকলেও ওই জিলিপিকে হাটের প্রাঙ্গনে ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে অনেক দূর, অনেক টাই দূর।
হাটের জিলিপি তো ছিল মূলত বারোমেসে খাবার, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা জিলিপিই ছিল আমার ভরসা। কিন্তু আরো কিছু মুখরোচক এবং মনরচক খাবারের কথা না বললেই না । সেগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম যেটি আসে সেটি হলো, নলেন গুড়ের পাটালি। হ্যাঁ এই একটি জিনিস যার স্থান আমার কাছে জিলিপির পরেই। গ্রামের সপ্তাহের অন্য দিন গুলোতেও গুড় এবং গুড়ের পাটালি পাওয়া গেলেও হাটের সনাতনের আনা গুড়ের পাটালির ব্যাপারটাই ছিল আলাদা । ঠিক দুপুরের দিকে এসে বসত পাটালি বেচতে। শীত কালে প্রতিবছর আমার জন্মদিন আসে, আর ওই দিন বাড়িতে কিছু না হলেও মা একটু পায়েস অবশ্যই রান্না করবে। আর সেটি যেমন তেমন নয় , হাটের থেকে আনা পাটালির গুড়ের ।
আমাদের পরিবারটি পুরুপুরিই হাটের উপর নির্ভরশীল, কেন সেটা এবার সে কথায় আসা যাক । আমার আব্বারা হলো গিয়ে পাঁচ ভাই। বড়ো ভাই কাশেদ আলী সেখ তার জমিজায়গা যতটি আছে তা পুরো টাই হাটের প্রান্তরে , মানে হাট যেখানে শেষ হয় সেখান থেকে উত্তর দিকে পর্যন্ত প্রায় অনেকটা জমির মালিক বড়ো আব্বা নিজে। তার চারটি ছেলে তাদের মধ্যে প্রথম তিনজন বিবাহিত এবং তাদের একটি দুটো করে ছানা পোনা আছে , যায় হোক কূল মিলিয়ে সে এক বিশাল পরিবার। বড়ো আব্বার বিশাল সম্পত্তিতে আছে একটি বড়ো পুকুর , সেই পুকুরের এ পাশে বসে ওপারে দেখতাম হাটের সব্জি ওয়ালাদের সব্জি বিক্রি , পুকুরের পার ধরে এক লাইনে ছিল সব্জির দোকান গুলি।আমার মনে আছে ছোটবেলায় বড়ো আব্বার জমিতে অনেক রকম সব্জি চাষ হতো , শীতকালে হতো বাঁধা কপি, হাটের দিন আমি ও আমার দাদারা মিলে একবার অনেক বাঁধা কপি বিক্রি করেছিলাম হাটে , ‘বাঁধা কপি তিন টাকা, বাঁধা কপি তিন টাকা’ এই ভাবে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বিক্রি করেছিলাম সারাদিন, সেদিন বিক্রিও হয়েছিল অনেক বাঁধা কপি, বিয়ের সিজেন ছিল তখন আর সেই সময় বাঙালি মুসলিম বাড়িতে বিয়ে মানে বাঁধা কপির ছেঁচকি আর কলাইয়ের ডাল ছিল আবশ্যিক, আর গ্রামের কোন বাড়িতে বিয়ে হলে সেই বিয়ে বাড়ির বাজার করা হতো বৃহস্পতিবারের হাটে, সেই হাট! বড়ো আব্বার চাষের জমির কোল ঘেঁষে থাকা হাট!।বড়ো আব্বা আজ আর নেই। বেঁচে থাকতে থাকতে হাটের ঠিক প্রান্তে বানিয়ে গেছে এক বিশাল বাড়ি। বড়ো আব্বার মেজ ছেলে সেই বাড়ির নিচের তলায় একটি হোটেল চালায়। বড়ো আব্বা বেঁচে থাকতেই ওই হোটেলের নামকরন করে যায় , আমাকে একদিন ডেকে বলে ‘বাপ দোকানের একটা নাম ঠিক করে আর্ট পিপারে বড়ো করে লিকি দিস দিনি’ , বড়ো আব্বাই যদিও হোটেলের নামকরণ করে , তার নাম হয় ‘মুসাফির – মুসলিম হোটেল’ । সেদিন নীল – লাল – সবুজ তিন রকম স্কেচ পেন মিশিয়ে বড়ো করে লিখে দিয়েছিলাম হোটেলের নাম টা। এখন বড়ো আব্বা আর নেই, হোটেলের ওই আর্ট পেপারটাও আর নেই। হোটেলটা এখনো আছে সপ্তাহের বাকি দিন গুলি ধরা খদ্দের থাকে , আর হাটের দিন থাকে খুবই ব্যস্ততা। যদিও সারা সপ্তাহে হোটেলের একটিই মেনু থাকে সেটি হলো ‘গরুর মাংস’ আর ভাত । কোভিডের সময় যখন পড়াশোনা সকলের লবডঙ্গায় যায় তখন, রোহন আমার দাদার ছেলে (বড়ো আব্বার নাতি) তাকে বেশ ভালো ভাবেই হোটেল টিকে ম্যানেজ করার ট্রেনিং দেওয়া হয় । এখন সেই হোটেলের ম্যানেজার বলতে গেলে রোহন নিজেই। সকাল বেলায় চন্দন পুর থেকে আসে গরুর মাংস, রোহন সেই মাংস তুলে ধুয়ে মশলা মাখিয়ে রেখে দেয়। তারপর দাদা সেই মাংস রান্না করতে বসে। যখন এক উননে মাংস রান্না চলে তখন অন্য উননে রোহন ভাত চাপায়। সপ্তাহের অন্য দিন গুলো খুব মেপে ভাত চাপায় রোহন আর বৃহস্পতিবার মানে হাটের দিন সকাল দুপুর বিকেল তিন বেলা ভাত চাপাতে হয় রোহন কে। বড়ো আব্বার বড়ো ও সেজ ছেলে থাকে কেরালায় রাজমিস্ত্রির কাজে। ছোট ছেলে বিয়ে করে একটি মেয়েও আছে, সে তেমন কোন কাজ করেনা বললেই চলে, তবে প্রতি বৃহস্পতিবার ছোট দা আর বৌদি মুসাফির মুসলিম হোটেলের পাশেই একটি ছোট্ট চায়ের দোকান খোলে। দোকানটি শুধুই হাটের দিন খোলা হয়। চা, ডিম টোস্ট, কেক, বিস্কুট, কলা, ডিম সিদ্ধ, অমল বিড়ি, জয় বিড়ি, কালি বিড়ি, পান, শিখর, রজনীগন্ধা, গোলফেলেক ইত্যাদি ইত্যাদি।
ছুটিতে বাড়ি গেলে ছোট বৌদি এই দোকান থেকেই একটা সিগারেট লুকিয়ে রাখত আমার জন্য। আমি বিকেলে দেখা করতে গেলেই চুপি চুপি গুঁজে দিত আমার পকেটে।
গোরুর মাংস বলতে মনে পড়ল বুধবারের মুসলিম হোটেল গুলোর কথা । হ্যাঁ এবার বৃহস্পতিবার নয় বুধবার। বৃহস্পতিবার যতগুলি মুসলিম হোটেল হাটে বসে তাদের প্রস্ততি পর্ব শুরু হয়ে যায় বুধবার বিকেলের পর থেকে, বুধবার সন্ধ্যা বেলাতেও এক রাউন্ড মাংস রান্না চাপানো হয়। সবগুলি হোটেল বসে এক লাইনে। এর মধ্যে সব থেকে বিখ্যাত হলো বেলডাঙ্গা থেকে আসা গোপালের হোটেল। নাম গোপাল হলেও ধর্মে সে মুসলিম । পুরো নাম গোপাল উদ্দিন । দেশের এমন এক কঠিন সময়তে এটি খুব হাস্যকর শোনালেও এটাই সত্যি যে, গ্রাম বাংলার কোন গাঁয়ের হাটে খুব সুন্দর গরুর মাংস রান্না করে গোপাল। বুধবারে মাঠে খেলতে আসত না ফটিক, টিকু , আলিম রা , ওরা ওই হোটেল গুলোতে পার্ট টাইম কাজ করত। হাতে দুটি পয়সা আর রাতে পেট ভরে গরুর মাংস ভাত আর পুঁই শাকের তরকারি। এই ছিল তাদের ওইদিনকার আয়। আমার মনে পড়ে , আমি যখন খুব ছোট রাত্রে খেতে চাইতাম না, মা ছোট দা কে দিয়ে আনিয়ে নিত গরুর মাংসের তরকারি, তখন নিত দশ টাকা প্লেট এখন তা বেড়ে গিয়ে হয়েছে ষাট থেকে সত্তর টাকা প্লেট। বুধ বার রাত্রে বহু মানুষ খেতে আসত ওই হোটেল গুলোতে তাদের মধ্যে অনেকেই আবার অমুসলিম (যারা চুপি চুপি আসত), টালির চালার নীচে দূর থেকে দেখা যেত সারি বাধা হোটেলের টাংস্টেনের আলো। হোটেলের চালা থেকে বেরিয়ে আসত ধোঁয়া । সেই ধোঁয়া ছুঁয়ে যেত আকাশের দিকে যেদিকে সব কিছুই সমান, খাবারের যেখানে ধর্ম নেই জাত নেই । গোপালের হোটেল তারই উদাহরণ।
আমার সেজ আব্বা ছিলেন কষাই, খাসীর মাংস সাপ্লাই করতেন বিভিন্ন হোটেল গুলিতে । আমি যখন ক্লাস সেভেন তখন সেজ আব্বা মারা যায় ক্যান্সার রোগে , যেদিন তিনি মারা যান কুরবানী ঈদ ছিল সেদিন । কুরবানী আর হাট আর সেজ আব্বা এই তিনটি মিলায়ে একটি স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রতিবছর কুরবানী ঈদের সপ্তাহ দশেক আগে আব্বা কুরবানীর খাসি কিনত। খাসি কেনার আগে সেজ আব্বাকে সঙ্গে নিত, সঙ্গে আমিও থাকতাম আর আমার কাকার ছেলে কেলু। ছাগল হাট বরাবরই গরুর হাটের আগে বসে, তাই সকাল সকাল চলে যেতাম আমরা দল বেঁধে। সেজ আব্বার এক অসাধারন স্কিল ছিল, সে ছাগলের লোম ছুঁয়ে বলে দিত কত কেজি মাংস হবে এই ছাগল টির । একথা আমি শুনেই এসেছিলাম একটা সময় পর্যন্ত, প্ৰথমবার যখন তার সাথে খাসি কিনতে গেলাম সে খাসি টিকে ভালো করে দেখল, দু একবার পিঠে হাত বোলালো তারপর বলল ‘নাশির এটা নিয়ে নে 30 কেজি মাংস হবে , এখন খাশিটিকে ভালো করে খাওয়ানো আছে তবুও কমলে দু আড়াই কেজি কমবে’। দশ দিন পর কুরবানী ঈদে নামাজ পড়ে এসে মৌলানা সাহেব বিসমিল্লাহ করে দিলেন খাসিটিকে , আর হ্যাঁ একদম তাই ওজন করে দেখা গেল টোটাল মাংস সাতাশ কেজি আটশ গ্রাম । সেজ আব্বা এখন আর নেই , তাই হাট থেকে খাসি কেনার আত্মবিশ্বাস টাই চলে গেছে । কেউ আর খাসি ছুঁয়ে বলতে পারবেনা ‘এটার মাংস তিরিশ কেজির কম হবেনা’।
হাটের দিন আমার ছোট আব্বা , মেজ আব্বা , সেজ আব্বার ছেলে নজরুল দা , আলতাফ ভাই (পিসির ছেলে) এরা সকলেই ব্যস্ত থাকত হাটে গরু ব্যাচা কেনা নিয়ে। একহাটে গরু কিনে অন্য হাটে বেচা এটাই ছিল তাদের ব্যIবসা। এজন্য আমাদের পরিবারকে গ্রামে বলা হত ‘ব্যাপারী গুষ্টি’। মেজ আব্বা ছিল বরাবরই একটু ভোজন রসিক , হাটে গোরু ব্যাচায় লাভ লোকসান যায় হোক না কেন , সেদিন দুপুর গড়াতে না গড়াতেই বাড়ি তে পাঠিয়ে দিত বড়ো রিঠা মাছ। রিঠা নামক এই বৃহৎ সামুদ্রিক মাছের সাথে আমার পরিচয় ঘটে এই হাটের মাধ্যমেই। হাট মানেই রবি কাকুর দোকানের রিঠা মাছ। আমি আব্বার সাথে ছোটবেলায় খুব গেছি মাছ কিনতে। রবি কাকু দূর থেকে আব্বা কে দেখেই হাঁক দিত , ‘এই নাশির দেখ যা আজকে একদম সলিড রিঠা আছে’। আব্বা আবার রবি কাকুর সঙ্গে মাছ কিনতে গিয়ে খুব দরদাম করত । শেষমেশ একটা দামে দুজনে স্থির হত তারপর দে বটির মার মাছের উপর। রবি কাকু শেষ একটা লাইন বরাবরই বলত ‘মাছ টা খাওয়ার পর আমায় এসে বলিস, রবি কাউকে ঠকায় না !’।
বিকেলে রবি কাকু হাট থেকে সব গুটিয়ে সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে আমাদের বাড়ির সামনে একটা জোরে হাঁক দিত ‘বৌদি ! মাছ টা কেমন ছিল?’
আমাদের গ্রামের চারপাশে আছে প্রচুর ইট ভাটা, গঙ্গা জলঙ্গি ঘিরে রেখেছে আমাদের ছয় সাতটি গ্রাম কে । তাই প্রচুর ইট ভাটা রয়েছে এই এলাকায় । গঙ্গার পলি মাটির ইট । এই ইট ভাটা গুলির মালিক মূলত এলাকার বিত্তশালী পরিবার গুলি । আর এগুলোতে কাজ করত ঝাড়খন্ড থেকে আসা বহু আদিবাসী মানুষ। ওরা এলাকার প্রতিদিনের বাজারে আসার সময় পায়না এবং প্রতিদিন এর বাজারের সব্জি ও অন্যান্য জিনিসের দাম হাটের থেকে দু পাঁচ টাকা বেশি , তাই ওরা বরাবর ভরসা করত হাট কে । হাটের দিন ওদের কাজের ছুটি থাকে ইট ভাটায়। ওই দিন টা ওদের বাজার করার দিন। লছিমন গাড়িতে (তিন চাকার মটর ভ্যান) চেপে দল বেঁধে ওরা আসে হাটে। শাক সব্জি , মশলাপাতি , গামছা , জামা কাপড় , চটি জুতো , টর্চ লাইট সারাই নিত্য প্রয়জনীয় জিনিস যা লাগে সব ওরা কিনে নিয়ে যেত হাট থেকে। আর চাল-ডাল আর তেল এই তিনটি জিনিস ওরা কিনত পাতা ভাই এর মুদি খানা দোকান থেকে। সেই ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি , পাতার দোকানে বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বিকেল অব্দি ভিড় লেগে আছে ওদের , ছেলে মেয়ে বউ বাচ্চা সবাই মিলে ওরা আসত বাজার করতে। তারপর সন্ধ্যা গড়াতেই হই হই করে ফিরে যেত যে যার ইট ভাটায়।
হাট আর জীবনের ওঠা নামা গুলো যেন এক সাথে লেগে আছে । জীবনের সমস্ত উৎযাপন আর সমস্ত ট্রাজিডির সাক্ষী এই হাট। বাড়ি তে বিয়ে হোক আর পার্বন , তার বাজার করা হতো হাট থেকে । বাঁধা কপি , পেঁয়াজ , সব্জি , আলু , আদা রসুন , শুকনো লঙ্কা , পাঁচ ফোড়ন গরম মশলা সব কিছু কেনা হয় এই হাটে। বচ্চন দার বিয়েতে , রাখিবা দির বিয়েতে , বাপ্পা ভাইয়ের বিয়েতে , পাপাই এর মুসলমানিতে (সুন্নত) , বড়ো ভাবির সাধে ,এই সমস্ত কিছু তে হাট থেকেই এসেছে , বাঁধা কপি , আলু , সব্জি , পেঁয়াজ , আদা রসুন , শুকনো লঙ্কা , পাঁচ ফোড়ন ।
আব্বার সঙ্গে আঙ্গুল ধরে ঘুরে ঘুরে শিখেছি হাটে বাজার করা। তারপর আব্বা একদিন আমায় ছেড়ে চলে গেল, আব্বার মৃত্যুর চারদিনের কাজেও বাঁধা কপি, সব্জি, আলু , আদা, রসুন, পেঁয়াজ, শুকনো লঙ্কা, পাঁচ ফোড়ন কিনতে এসেছিলাম এই হাট থেকেই। এখনো আব্বার মৃত্যু বার্ষিকী তে এই সবকিছুই আসে ওই বৃহস্পতিবারের হাট থেকেই। সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার আমার জন্ম বার টাও নাকি বৃহস্পতিবার এবং আব্বা যেদিন মারা গেলেন সেদিন টাও ছিল বৃহস্পতিবার ।
এখন আমি পরিযায়ী দু বছরে একবার ফিরি গ্রামে । সময় পেলেই চলে যাই হাটে এক কোনায় বসে স্কেচবুকে ছবি আঁকতে থাকি। হাট , সেই হাট , বৃহস্পতিবারের ধুবুলিয়া গ্রামের হাট।
Nice read. Nice drawing.