মাংস-কথা
রূপায়ন মুখোপাধ্যায়
Volume 2 | Issue 11 [March 2023]
মাংস খাওয়ার শখ সেই জ্ঞান-বয়স থেকে।
ছেলেবেলায় মাংস খাওয়ার চেয়ে খাওয়ার ভাবনাটাই বেশি উপাদেয় ছিল। তখন মফস্বল শহরে রেস্তোরাঁর ছড়াছড়ি হয়নি, মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ বাড়ির হেঁশেলে প্রায় নিষিদ্ধ ইস্তাহার ছাপার মতন গোপনীয়তায় চিকেন রান্না হয়। তবু কলকাতায় বড় হওয়া গৃহিণীর সিদ্ধহস্তে তৈরি সেই খোলতাই মাংসের গন্ধ, রান্নাঘরের ভেজানো জানালা ছাপিয়ে, বাঁশের বেড়ার ওপারে থাকা জ্ঞাতিদের নাকে পৌঁছে যাওয়া সদাসম্ভব। মা তাই ছেলেকে শিখিয়ে দেয়, “ওঘরের বড়মা যদি জিজ্ঞেস করে, বলবি দুপুরে মটন্ খেয়েছি।” বাঁশের ধনুক আর পাটকাঠির তীর নিয়ে খেলায় ব্যস্ত ছেলে ‘অশ্বথামা হত’টুকুই শোনে, ‘ইতি গজ’ শোনার মতন ধৈর্য বা মনযোগ তার নেই। বিকেলে বড়মা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বেমালুম বলে বসে “দুপুরে পাঁঠার মাংস খেয়েছি”। বড়মার সন্দেহ হয়, সামান্য আমসত্ত্বের বিনিময়ে সত্যান্বেষণ সফলভাবে সমাপন হয়। বিশ্বাসঘাতক পুত্র নিবিষ্টমনে আমসত্ত্বের আস্বাদন করতে করতে বলে “মা শিখিয়ে দিয়েছিল…আসলে চিকেন রান্না হয়েছিল”।
কিছুটা নিষিদ্ধ বলেই হয়তো, ছেলেবেলায় আমার মটনে্র চেয়ে চিকেন বেশি পছন্দ ছিল। ছোটদাদু নিরামিষাশী ছিলেন, তবু আমি তাঁর পাশে বসে দিব্যি মুরগির ঠ্যাং চিবোতাম। জ্বর হলেই রুচি ফেরানোর জন্যে বাবা মাংস নিয়ে আসতেন বাজার থেকে। ঠাকুমা ওসব ‘ম্লেচ্ছ’ খাবার নিজে খেতেন না, কিন্তু আমার জন্যে খুব যত্ন করে গোটা শুকনো লঙ্কা দিয়ে পাতলা ঝোল রাঁধতেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে, সর্দিজমাট নাকেও আমি সেই গন্ধ পেতাম।
উনবিংশ শতকের বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণীর দৈনন্দিন হেঁশেলে মাংসের অনুপ্রবেশ ও অন্তর্ভুক্তির ইতিহাস বড়ই সরেশ। সচেতন পাঠক এই ইতিহাসের পাঠে, বিশেষত এই অন্তর্ভুক্তির ধরণে, এক অনুরূপ ইতিহাসের সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পেতে পারেন। আধুনিকতার ইতিহাস। আপাতভাবে বৈদেশিক হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র ব্যবহারিক ও প্রয়োগিক স্বার্থে বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণী যেভাবে আধুনিকতাকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই, শুধুমাত্র খাদ্যগুণের হেতু, মাংস মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রাত্যহিক হেঁশেলে স্থানাধিকারে সক্ষম হয়েছিল।তবে, এখানে বলে রাখা ভালো যে বাংলার রসনা-সংস্কৃতিতে মাংস কিন্তু কখনই সার্বিকভাবে অনুপস্থিত ছিল না। বরং, উতসা রায়, শুভজিত হালদার প্রমুখের মতে, আদি ও মধ্যযুগের বঙ্গ সংস্কৃতিতে মাংসাহারের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন, রায়গুনাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে অন্নপূর্ণা কর্তৃক প্রস্তুত বিবিধ পদের মধ্যে অন্যতম “কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝাল ঝোল রসা” এবং “অন্ন মাংস সিক ভাজা কাবাব…”। আবার, মুকুন্দরাম রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের একটি বিশেষ সংস্করণে কালকেতুর জন্যে ফুল্লরা যে ভোজের আয়োজন করেছেন, তার অন্যতম উপাদান মৃগ ও নেউলের মাংস।
তবে লক্ষণীয়, মঙ্গলকাব্যে মাংসের বিবিধ পদের উল্লেখ কিন্তু কোনো বিশিষ্ট ভোজসভার আনুষ্ঠানিক চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ, যার সাথে মধ্যবর্গের বাঙালি হিন্দুর দৈনন্দিন রসনা-সংস্কৃতির কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। এছাড়া, পাঠক হিসেবে আমাদের এটুকু মনে রাখাও অবশ্যকর্তব্য যে অধিকাংশ মঙ্গলকাব্যের রচয়িতারা ছিলেন অ-বৈষ্ণবধর্মালম্বি এবং উপরিউক্ত মঙ্গলকাব্যগুলি রচনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গীয় সাংস্কৃতিক জীবনে বৈষ্ণব সাংস্কৃতিক একাধিপত্যের প্রতিরোধ। তাই, শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত নিরামিষ খাদ্যসংস্কৃতির এক প্রকট অস্বীকার এবং বিবিধ আমিষ পদের বর্ণনা এইসব সাহিত্যকর্মে সচেতনভাবে প্রতিফলিত হওয়াই অত্যন্ত স্বাভাবিক। পাঠক হিসেবে তাই, এইসব বর্ণিত আমিষ ভোজসভাকে বাস্তবের যথার্থ প্রতিরূপ হিসেবে বিবেচনা প্রসঙ্গে, আমাদের এক সঙ্গত সন্দেহের অবকাশ থাকতেই পারে। বাঙালির আমিষাহার বিষয়ে গোলাম মুর্শিদের মতামত সেই সন্দেহকে আরও গভীর করে তোলে। তাঁর মতানুযায়ী, আদি ও মধ্যযুগে মূলতঃ উচ্চ ও নিম্নবর্গের বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানেরা মাংসাহারে রুচি রাখতেন। প্রাত্যহিক জীবনে মধ্যবর্গের হিন্দুর আমিষের সাথে আশনাই সীমিত ছিল মাছ অবধি। ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে মীনভক্ষণেও, আপাতদৃষ্টিতে, বিবিধ বিধিনিষেধ ছিল। বৃহধধর্মপুরাণ অনুযায়ী সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ শুধুমাত্র রুই, পুঁটি, শোল এবং কতিপয় শুক্লশল্কবিশিষ্ট মীনভক্ষণে অনুমিত ছিলেন। নিষেধের অন্যথা হত কিনা সেই তর্ক অপ্রাসঙ্গিক, মধ্যবর্গের দৈনন্দিন রসনা-সংস্কৃতিতে যে তাত্ত্বিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মাংস ব্রাত্য ছিল, সেটাই আপাতত আমাদের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ। অষ্টাদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন সালিম তাঁর রিয়াজ–উস–সালাতিন গ্রন্থে বাঙালির খাদ্যাভাসে মাংসের অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে লিখেছেন, “এ দেশের উঁচু-নিচু সবাই মাছ, ভাত, সর্ষের তেল, দই, ফল আর মিঠাই খেতে পছন্দ কর্রে…ঘিয়ের রান্না খাসি এবং মোরগের মাংস তাদের মোটেই সহ্য হয় না।” মাছে-ভাতে বাঙালির জরাজীর্ণ পাচনতন্ত্রের পক্ষে মাংসের উদরায়ণ যে অসম্ভব, সালিম তাঁর আলোচনায় এরকমই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
তাই সম্ভবত একেবারেই অ-কাকতালীয় এবং যথাযথভাবে, ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে মধ্যবিত্ত বাঙালির, অর্থাৎ ভদ্রলোক শ্রেণীর, রোজকার হেঁশেলে মাংসের অন্তর্ভুক্তিকরণের নেপথ্যে যে যুক্তি সাজানো হয়েছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে বাঙালির স্বাস্থ্য-বিষয়ক সচেতনতা। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী তাঁর আমিষ ও নিরামিষ শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকায় পুরাণের আলোকে মানবিক খাদ্যাভাস ব্যাখ্যার এক উৎসাহী প্রচেষ্টা করেছেন। তাঁর আলোচনায় ফিরে ফিরে এসেছে মাংসাস্বাদনের সাথে “কাম ক্রোধাদি রিপুগণের বশীভূত অসুরের…হিংস্র স্বভাবের” এক গুরুত্বপূর্ণ, এবং পৌরাণিক (প্রায় ঐতিহাসিক) সংযোগ। “পিশাচ অসুরেরা আমমাংস প্রভৃতি ভক্ষণ করিত আর উন্নত হৃদয় দেবতারা দুগ্ধ সোমরস, ঘৃত ও বৃক্ষফল প্রভৃতি অমৃতোপম নিরামিষ আহারে প্রধানতঃ জীবন ধারণ করিতেন”—প্রজ্ঞাসুন্দরীর আলোচনায় খাদ্য ও স্বভাবিক যোগ খুব প্রকট। তাই, দেব ও কালক্রমে ঋষিকূলের উত্তরসূরি মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে আমিষে অভিরুচির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরীর আলোচনায় চলে আসে খাদ্যগুণের তত্ত্ব। আয়ুর্বেদ নামক চিকিৎসাবিদ্যার উদ্ভাবনের হেতু ও ‘শরীরধারণোপযোগী’ গুণের কারণে দেব ও ঋষি কুলোদ্ভব মানুষের আমিষাহারে রুচি জন্মাল, প্রজ্ঞাসুন্দরীর দীর্ঘ ভূমিকা এরকম সিদ্ধান্তের দিকেই ইঙ্গিত করে। তাঁর আলোচনায় মাংস, এবং বৃহত্তর অর্থে আমিষ, ‘ওষধিপ্রধান খাদ্য’ হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে। আরেক সমসাময়িক পাকশিল্প বিশারদ বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের অভিমতে, “হিন্দু-জাতির-মধ্যে পাশব-খাদ্যের অর্থাৎ মাংসাদির অধিক ব্যবহার দেখা যায় না”। তাঁর প্রণীতপাক–প্রণালী গ্রন্থে বিবিধ মাংসের পদের প্রস্তুতি পদ্ধতি বর্ণিত আছে বটে, তবে তার সবটাই আলোচিত হয়েছে শারীরিক পুষ্টিসম্বন্ধিত আলোচনার প্রেক্ষাপটে। মেষমাংস, মৃগমাংস, ছাগমাংস ইত্যাদি বিবিধ মাংসের নির্বাচন ও রন্ধন প্রসঙ্গে তাই ‘রোগী’ হয়ে উঠেছে এক গুরুত্বপূর্ণ সূচক। “মাংস আহার করিয়া শারীরিক পুষ্টি-সাধন করা যায়”, অতএব, স্বভাববিরুদ্ধ হলেও মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু যদি স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে মাংসাশী হয়ে ওঠে তবে তা অনৈতিক ধর্মচ্যুতি নয়। ব্যতিক্রমী সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের গলাতেও, মাংসাহার সম্বন্ধে তত্ত্বালোচনায়, প্রায় একই সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে। অভুক্ত দেশবাসীর স্বাস্থ্যোন্নতি ও স্বাস্থ্যোদ্ধারের প্রয়োজনে এবং গভীর জাতীয়তাবোধের আলোকে উদ্দীপ্ত এক সাহসী, সঙ্কল্পিত এবং সক্ষম জনজাতির নির্মাণের জন্যে খাদ্যাভ্যাসে মাংসের সংযোজন যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিবেকানন্দের আলোচনায় তা বেশ স্পষ্টভাবেই ব্যক্ত হয়েছে। মাংসাশী কলিজা ব্যতীত সবলের পদদলনে নিষ্পেষিত দুর্বলের অভ্যুত্থান তো দুরস্ত, বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই ক্ষীণ। তাই, বিবেকানন্দের মতে, হৃদয় দিয়ে না হলেও অন্তত পাকস্থলী ও যকৃৎ দিয়ে মাংসকে আপন করাই পরাধীন দেশবাসীর প্রধান কর্তব্য। রসিঙ্কা চৌধুরী তাঁর ফ্রিডম অ্যান্ড বিফ স্টেক্স গ্রন্থে ঊনবিংশ শতকের বাংলা তথা ভারতে মাংসাহারের স্বপক্ষে প্রবর্তিত বিবিধ তাত্ত্বিক যুক্তির পেছনে যে জাতীয়তাবাদী স্বার্থ ও উদ্দেশ্যের সন্ধান পেয়েছেন, বিবেকানন্দের মাংসাহারের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধিত আলোচনা তার অন্যতম নিদর্শ।
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র আবাসনে শুক্রবার রাত ছিল উৎসবের রাত, কারণ সেই রাতে বাগানের হাসনুহানা অথবা ঠাকুরঘরের ধূপ-রজনীগন্ধার সুবাস ছাপিয়ে নাকে এসে লাগত সপ্তাহভর প্রতীক্ষিত মাংসের চেনা গন্ধ। চেনা, তবু চেনা নয়। সেই গন্ধের হাতছানিতে, চায়ে ভেজা ম্যাডেলানের গন্ধে আচ্ছন্ন মার্সেল প্রাউস্তের উপন্যাসের নায়ক চার্লস স্ব্যোয়ানের মতন, আমি পাড়ি দিতাম স্মৃতিমেদুর অতীতের পরবাস্তবিক ছায়াপথে। দেশান্তরী কিশোরের সদ্য ফোটা মানসনেত্রে তখন ফুটে উঠত ছেলেবেলার দুপুর। রবিবার মাংসবার, বারান্দায় পাত পেড়ে আমরা সপরিবারে খেতে বসেছি, মাটির উনুনের জ্বালে সুসেদ্ধ হওয়া পাঁঠার মাংস আমার জন্যে আলাদা বাটিতে মা বেড়ে দিচ্ছে। আজ আমার কোন ঝঞ্ঝাট নেই, মাংস হওয়ার আনন্দে আজ আমি নিজের হাতেই খাব। দাদু আর বাবার মাঝখানে বসে আমি চোখ বন্ধ করে একমনে হাড় চিবোচ্ছি, বাবার ঈষৎ উদ্বিগ্ন গলা শুনলাম “সাবধান, গলায় না ফোটে! ওকে এসব হাড়-মাংস না দিলেই তো পারো!” শেষের কথাটা মায়ের উদ্দেশ্যে বলা। “হাড় খাওয়া শিখুক, নাহলে বড় হবে কি করে?” মায়ের গলায় প্রচ্ছন্ন আস্কারার সুর স্পষ্ট।
চোখ বুজেঁ হাড় চিবোতে চিবোতে কখন একদিন বড় হলাম তা সঠিক না জানলেও মাংসের মাইলফলক জীবন যাত্রায় এক অবিচ্ছেদ্য সহযাত্রী ছিল। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে বন্ধুরা রেস্তোরাঁয় গিয়ে ফ্রাইড রাইস চিলি চিকেন খেয়েছিলাম, রেজাল্ট বেরোনোর পর বন্ধুদের বাড়িতে ডেকে ঘটা করে পোলাও আর চিকেন কোর্মা খাইয়েছিলাম। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিষয়ক বিরক্তিকর টিউশনগুলো কামাই না করার দুটি প্রধান কারণ ছিল। এক, বুকে কাঁপন ধরানো এক জোড়া চোখ যার ঠোঁটের এক চিলতে পরশ পাওয়ার জন্যে আমি তাঁর পথের ধুলো হতেও রাজি ছিলাম। আর দুই, পড়া নামক অত্যাচারের শেষে আমরা আশেপাশের কোনো সস্তা দোচালা খাবারের দোকানে ভিড় জমাতাম—সেখানে তখন চিকেন পকোড়া বা ফাউল কাটলেট ভাজা হচ্ছে। ঠোঁটের আস্বাদন এ জীবনে পাওয়া হবে না জেনে ঘোলেই দুধের স্বাদ মেটাতাম, খুব মনযোগ সহকারে চিকেন পকোড়ায় কামড় বসাতাম। তাই নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সাথেই হয়তো বা, সুইফ্ট ডিজায়ারের ভেতর থেকে সেই মৃগনয়নীযুগল কখনও আমার দিকে তাকিয়েছিল কিনা তা আমার খেয়াল করা হয়নি। আমার তখন চোখ বন্ধ, মুখের ভেতর আধপোড়া চিকেন পকোড়ার শক্ত হাড়।
তারপর একটুকরো হাড় গলায় আটকালো, ফিজিক্সে তেতাল্লিশ বা অঙ্কে বাহান্ন সজ্জিত আমার আই এস সির মার্কশিটের মতন। না পারি গিলতে, না পারি ফেলতে। ভবিষ্যৎ ভেন্টিলেশনে ঢুকে গেছে, প্রবেশিকা পরীক্ষা নামক অস্ত্রোপচার তখন শেষ ভরসা। কপাল ঠুকে সে যাত্রায় ফাঁড়া কাটল, তবে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি হতে গিয়ে প্রথমেই শুনলাম অধ্যক্ষ মহারাজের হুঁশিয়ারি—“এখানে কিন্তু কৃচ্ছসাধন করতে হবে…বাড়ির মতন রোজ রোজ মাছ ‘মাংস’ হবে এরকম আশা কোরো না।“ তক্ষু্নি গটগট করে ফেরত চলে আসা যেত, কিন্তু ভবিষ্যৎকে মাংসের চেয়ে অগ্রাধিকার দিতেই হল।
সেই নির্বাসনের নরেন্দ্রপুরে, পরিতোষদার মাপা হাতে সাঁতলানো মাংসের গন্ধ ছিল আমার কাছে কান্তবাবুর কর্নেটের সিন্ধু বারোয়াঁ রাগ। সেই গন্ধের রেশে আমার, হরিপদ কেরানির মতন, আবাসিক ঘর, পড়ার টেবিল, দূরের পাঁচিলের ওপারে ভেসে আসা ব্যস্ত শহরের শব্দ—সব “দুর্বিষহ, মাতালের প্রলাপের মতো” মিথ্যে মনে হত। একমাত্র সত্য তখন কোনো শীতের দুপুরে তোর্ষার চরে বনভোজন কিম্বা মফস্বলি কোচবিহারের কোনো নিমন্ত্রণবাড়ি। এরকমই এক অনুষ্ঠানে একবার, সম্ভবত জীবনে প্রথমবার, বুফেতে মটন রোগানযোশ খেতে খেতে আচমকাই দেখা হয়ে গিয়েছিল আমাদের নবাগতা ক্লাসটিচার বিদুষী চ্যাটার্জীর সাথে। একরাশ লজ্জা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে আমি সেদিন তাঁর সাথে বেশি কথা বলতে পারিনি, মালাই কুলফি আর ফ্রূট কাস্টার্ড না খেয়েই স্থানত্যাগ করেছিলাম। তবে ক্লাস এইটের অঙ্কের খাতার পেছনে সস্তা উপমাখচিত বাজে প্রেমের কবিতাটা যে তাঁর উদ্দেশ্যেই লেখা হয়েছিল, এতদিন পরে তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করা যায়। কবিতাটা কিছুতেই মনে পড়ে না, কিন্তু মাংসের গন্ধটা ক্রমশ নিশির ডাকের মতন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। আবাসনের পড়ার টেবিলে পোর্ট্রেট অফ দি আর্টিস্ট খোলা ফেলে রেখে আমি রান্নাঘরের দরজায় পৌঁছে যাই, তারপর প্রাণ ভরে শ্বাস নিই…কি শান্তি, কি স্বস্তি, কি তৃপ্তি!! সদ্য পড়ে আসা স্টিফেন ডেডলাসের কথা মনে পড়ে, সেই ব্যতিক্রমী শিল্পীহৃদয় অশ্বমূত্র আর পচা খড়ের গন্ধে প্রশান্তি খুঁজে পেত। পোর্ট্রেট পড়তে গিয়েই জেনেছিলাম যে তার স্রষ্টা জেমস জয়েস নাকি অ্যামোনিয়ার গন্ধের আকর্ষণে বারবার পৌঁছে যেতেন কোনো সাধারণ শৌচালয়ের দরজায়। তখনও রাতের খাবারের ঘণ্টা পড়তে বেশ কিছুক্ষণ দেরি, আমি সেই গহীন গন্ধের সবটুকু শুষে নিতে রান্নাঘরের কাছে ঘোরাঘুরি করতাম। কথাটা আবাসনের সুপার মহারাজের কানে গেল, তিনি আমার মাংসের প্রতি আশক্তিকে ইন্দ্রিয়ের দাসত্বের সূচকস্বরূপ চিহ্নিত করলেন। আমার তাতে বয়ে গেছে! সেই কোন্ ছেলেবেলাতেই আমি সত্যজিৎ রায়ের ‘শিবু আর রাক্ষসের কথা’ পড়ে নিজের দাঁতগুলো আয়নায় দেখেছি, হ্যাঁ! শেয়াল কুকুরের মতন আমার শ্বাদন্তগুলো একটু বড়ই বটে! ডেন্টিস্ট কাকু বলেছিলেন ‘মিসঅ্যালাইনমেন্ট’, কিন্তু আমার নিজেকে ড্রাকুলার বংশধর ভাবতেই বেশি ভালো লাগত।
সুপার মহারাজের আর দোষ কোথায় বলুন! হালের মন্দার থেকে ‘মন্দ’ আলাউদ্দিন খিলজি, যে কোনো বিকৃত চরিত্রের উপস্থাপনায় অন্যতম উপাদান মাংস। গুপী গাইন বাঘা বাইনের ষড়যন্ত্রী মন্ত্রীমশাই হোক কিম্বা শোলের গব্বর সিং, মাংসপ্রীতি তাঁদের এক অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বাণিজ্যিক হিন্দি ছবিতে মাংসের উপস্থাপনা বিষয়ক এক নিবন্ধে আহমেদ মুবারকি যথার্থই বলেছেন যে মূলধারার ভারতীয় সাংস্কৃতিক চেতনায় মাংসলিপ্সাকে প্রায়শই মানসিক ও জৈবিক বিকৃতির সূচক হিসেবে দেখা হয়। মাংসানুরাগী ব্যক্তি যে কখনই মহানুভব হতে পারেন না, এরকম এক পূর্বধারণা আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মননে বহুযুগ ধরেই দৃঢ়বদ্ধ হয়ে আছে। ফ্রান্সেস্কো বুসেমির আলোচনার সুত্র ধরেই তাই বলা যেতে পারে যে সামাজিক প্রেক্ষিতে মাংস এক গুরুত্বপূর্ণ ‘সিম্বল’ বা প্রতীক। মাংসকামিতার সাথে জড়িয়ে আছে কামুকতা, লাম্পট্য, হিংসা, হিংস্রতার মতন বেশ কিছু পুরুষতান্ত্রিক চারিত্রিক অপগুণপ্রসঙ্গ। সেইসব প্রসঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে মাংসকামী পুরুষ, প্রায় যে কোনো আধুনিক সমাজে, এক সামাজিক ও মানবিক অপর হিসেবে চিহ্নিত হন।
“Meat fits you well”—সমাবর্তন অনুষ্ঠান অন্তে, সফলভাবে স্নাতকোত্তর সমাপনের প্রমাণপত্র হাতে নিয়ে, বাবুর্চিতে মটন বিরিয়ানি খেতে খেতে, আমার সহপাঠিনী মিত্রা আমায় বলেছিল। মিত্রার নারীবাদী অন্তর্দৃষ্টি আমার পুরুষতান্ত্রিক বিচারবোধ ও মাংসানুরাগের মধ্যে এক সহজাত সঙ্গতি (intrinsic correspondence) খুঁজে পেয়েছিল। ততদিনে অবশ্য আমার মফস্বলি গন্ধ ঢাকতে আমিও প্রাণপণে, অতিমাত্রায়, উত্তর-আধুনিকতার আতর মাখতে শুরু করেছি। তাই, নিক ফিড্স, স্লাভজ় জ়িজ়েক কপচে উদ্দীপ্ত তর্ক জুড়ে দিলাম। “তোর এই সরলীকরণের প্রবৃত্তিই এক প্রকট পুরুষতান্ত্রিক লক্ষণ…ফিড্স পড়লেই বুঝতে পারবি যে এই জাতীয় চিন্তাধারা আসলে বাজার ও তার বিবিধ সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার মাধ্যমের ফসল…”। মিত্রা যে খুঁটিয়ে ফিড্স পড়েছে তা আমি জানব কি করে? “হ্যাঁ, আমি জানতাম তুই এটাই বলবি…typical strategic রিডিং। ফিড্স নিজেই তো বলেছেন যে নারীকে ‘উপাদেয় মাংস’ ভাবাটা পুরুষের এক সহজাত, প্রায় অবচেতন, প্রবৃত্তি… “the idea exists in the mind”” মিত্রা অবলীলায় Meat: A Natural Symbol গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেয়। জবাবে আমি অবচেতন কি করে বাজার নামক সর্বগ্রাসী সহস্রভুজ দৈত্যের বিবিধ প্রাতিষ্ঠানিক ও তাত্ত্বিক হাতের দ্বারা নির্মিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়, সে বিষয়ে এক জ্ঞ্যান-গম্ভীর ভাষণ ঝাড়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি, এমন সময়ে রেস্তোরাঁর রঙিন বোকা-বাক্সের দিকে চোখ গেল। সদ্য ঘটে যাওয়া ‘এখলাখ মব লিঞ্চিং’ প্রসঙ্গে এক হঠাৎখ্যাত গেরুয়াধারী রাজনীতিবিদ যা বলছেন তার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় “যদি কেহ গোমাংস সেবনের স্বপক্ষে ওকালতি করেন তবে আমার মতে তাহা এক ধরণের মানসিক বিকৃতি। অনতিবিলম্বে ইহার উপযুক্ত চিকিৎসা প্রয়োজনীয়।“ আমার জিভে কামড় পড়ে, মিত্রা বিষম খায়, তারপর একান্ত আক্ষেপের সুরে বলে “ইস্…আজ আস্মায় বিফ বিরিয়ানি খেলে হত…”।
শীতের নরম রোদে নিকোনো উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, জিভ দিয়ে একমনে দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা গতরাত্রে বন্ধুর বাড়িতে নৈশাহারে খাওয়া মাংসের কুঁচি বের করার চেষ্টা চালাচ্ছি, হঠাৎ জিজ্ঞাসা শুনলাম, “পি এইচ ডি ইন্টারভিউ”? ঘুরে তাকিয়েই দেখি একজোড়া চোখ, শীতের প্রথম শিশিরের মতন স্বচ্ছ। অথচ, তার থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে মহাকালের সবচেয়ে আদিম দৃষ্টি। মনে হল, এই চোখকে ভবিতব্য না ভাবলে মানবজন্ম ব্যর্থ। জগৎ চরাচরের সব নিয়ম, সব নিষেধ, সব বাধা যেন সেই দৃষ্টির ছটায় চোখের পলকে, যে কোনো মুহূর্তে, বালির কেল্লার মতন ঝরে পড়বে। আর একবার সেই চোখ আমায় সুধোল “are you here for the PhD interview”? অপ্রত্যয়ী মাথা নেড়ে কোনোরকমে সম্মতি জানালাম। তারপর ধরা গলায় বললাম “আপনি”? দুজনের ইন্টারভিউ সমাপন হল, কথা ফুরোল না। দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা মাংস বেরিয়ে আসার আগেই আমরা ছায়াপথে সংসার সাজানোর সঙ্কল্প করে ফেললাম।
তবে রক্ত-মাংসের পৃথিবীর নিষেধ টপকে ছায়াপথে সংসার সাজানো বড়ই কঠিন। জাত, ধর্ম, শ্রেণী, পুরুষতন্ত্র—কত সূচক, কত শাসন, কত সংক্রমণ। সেসব সূচক সম্বন্ধিত সচতেনতারা কখন যে রক্তের সাথে মিশে যায়, শিরা উপশিরার পথ ধরে হৃদয়ের গহীনে এক টুকরো অবিশ্বাসকে লালন করে, ওথেলো তা বুঝতে পারার আগেই বেলা পড়ে আসে। অবিশ্বাসের ছায়া বেড়ে চলে, বাড়তেই থাকে, ভালোবাসার কক্ষপথের বাতাস জতুগৃহের মতন বিষাক্ত হয়ে ওঠে। ডেস্ডিমোনার দম বন্ধ হয়ে আসে, তবু আগামী রূপকথার আশায় বর্তমানের জতুগৃহকে মেনে নিতে হয়। তবে রাতজাগা কান্নাভেজা চোখে স্বপ্নভঙ্গের চিহ্ন মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না। তারপর একদিন মায়ের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে সে আমার সাথে মেলামেশা বন্ধ করে, স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি হয়। মেঘ মারফৎ তাঁর কাছে আমার নিঃসঙ্গ চিলেকোঠা আর শূন্য আঙিনার আখ্যান পাঠালেও শেষরক্ষা হয় না। বরং, দূত দ্বারা আমার কাছে ওপরওয়ালার বার্তা এসে পৌঁছোয় যে আমি যেন আর তাঁর সাথে মেলামেশার চেষ্টা না করি। নাছোড়বান্দা প্রেমিক কারণ সুধোলে দেবদূত জানায় “তুমি নিতান্ত অযোগ্য আসুরিক প্রবৃত্তির মাংস-প্রেমিক, তাই অমরত্বের প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা তোমার নেই। তোমার নিত্যদিন জ্বরা, ব্যাধি আর হার-মাংসের মলিন সৌরভেই সুরভিত থাকুক, পারিজাতের সুবাস তোমার কপালে নেই”।
সহৃদয় পাঠক। আবার কোনোদিন কোনো শীতের নরম রোদে নিকোনো বারান্দায় যদি একজোড়া চোখকে দেখে বুকে কাঁপুনি ধরে, যদি তাঁর সাথে ঘর বাঁধার এক সর্বনেশে ইচ্ছে হয়, যদি সেই চোখের আস্কারায় আবার অনেক ন্যাকা অথচ মহৎ প্রেমের গান বেসুরো গলায় গাইতে ইচ্ছে করে, তবে সেই চাহনির কাছে গিয়ে একবার বলবেন যে তাঁর ওপর এক পৃথিবী অভিমান করে (এবং হয়তো কিছুটা নিজের মানবিক প্রবৃত্তি প্রমাণের হেতু) আমি নিরামিষাশী হয়েছিলাম। অরুচির দোহাই দিয়ে বহুদিন মায়ের হাতের রান্না করা মাংসের বাটি দূরে সরিয়ে দিতাম। সেই পরম আত্মসংযমের অগ্নিপরীক্ষা আমি অনেক আশা নিয়ে দিতাম, ভাবতাম এবারে বিধাতা ঠিক সদয় হবেন আর আমি আবার ঐ ভাঙা পথের বাঁকটায় ফিরে যেতে পারব। যেখানে একদিন ‘কণে দেখা আলো’ কে সাক্ষী করে আমরা রূপকথা খোঁজার শপথ করেছিলাম।
চিত্রায়ণ– অন্বেষা দাস, বিপ্রজিত দত্ত, অভিরূপা রায়
Rupayan Mukhopadhay’s ‘ Mangsho Kotha’ is a revelation. Admirable scholarship in locating texts, modern and ancient relating to the consumption of meat and chicken in Bengal. Fascinating to know that the description of consumption of mutton, chicken in Mongolkavya , was intended to resist the satwik cuisine inherent in vaishnavism.
The essay perceives eating as a habit that is blended with memory and longing. Going against the grain in a neoliberal world order where fancy food and eateries dominate the class hierarchy, such works serve readers with the crumbles of human values that can still be preserved.
The essay perceives eating as a habit which is blended with memory and longing. Going against the grain in a neoliberal world order where fancy food and eateries dominate the class hierarchy, such works serve readers with the crumbles of human values which can still be preserved and cherished.
Nice ❤️❤️
Nice