অনুবাদ – চিরদীপ নাহা
Saranya Ganguly, 2021
শেষের দিন গুলোতে গায়েত্রী খাওয়া -দাওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছিলো। আমি মাঝেই মাঝেই তার দিকে তাকাতাম। তাকিয়ে দেখতাম সে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। লজ্জা লাগতো যে আমি এখনো খেতে পারছি। আমি লজ্জিত হতাম এটা ভেবে যে, ইস্টার্ন রেলওয়ের দাওয়া যে ছোট্ট ফ্ল্যাটে আমরা থাকতাম সেখানে ভাতের গন্ধ ম ম করতো কিন্তু গায়েত্রী খেতে পারতো না। আমি তাকে বিয়ে করি কবিতার জন্য আর সে আমাকে বিয়ে করে আমার রান্নার দক্ষতার জন্য। অনেকবারই কলকাতায় লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করার সময় সে আমাকে বলতো যে তার মতে আমার লাঞ্চ বক্সে রাখা খাবারটাই নাকি আমার সম্পর্কে দ্বিতীয় সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়। আর সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে খাবারটি আমি নিজেই রান্না করেছি।
গায়েত্রী বাড়ির সীমাবদ্ধতার বাইরে খেতে ভালোবাসতো। তার বাবা অনেকদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। স্কুল জীবন থেকে গায়েত্রী তার বাবার জন্য রান্না করা খাবারই খেয়ে এসছে। সেদ্ধ খাবার, কখনো কখনো আবার নুন ছাড়া। কখনো সখনো সামান্য আলু ভাজা তাও আবার কালেভদ্রে। গায়েত্রী বড়ো হয়েছে তার মাকে দেখে দেখে। তার মা কাজে যেত এবং কাজ থেকে এসেই রান্নাঘরে ঢুকতো। গায়েত্রীর বাবার দু -তিন ঘন্টা পর পরই খাবার খাওয়ার নিয়ম ছিল এবং সে খাবারের রং ভিন্ন ভিন্ন হতে হতো। তার জন্য লাল বীটরুটের পর আসতো সবুজ লাউ, সবুজ ঢেড়সের পূর্বে আসতো নীল বেগুন আর হলুদ কুমড়োর পরে আসতো কমলা গাজর। সঙ্গে খুব অল্প একটু ভাত।
একটা সময় পর সে তার বাবার অসুস্থতা দেখতে দেখতে আতংকিত হয়ে গিয়েছিলো। সে বলতো ঘরের মধ্যে দুরারোগ্য কোনো রোগ থাকা এতটাই গ্রাসকারী যে তার বাবার অসুস্থতার তিন বছরের মধ্যেই তাদের তিনজনের মধ্যের সম্পর্কটা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যায়। তাদের পরিবারটা নষ্ট হয়ে যায়। তাদের মধ্যে দুজন সেবা দানকারী আর একজন সেবা গ্রহণকারী হয়ে উঠে।
যখন শহরের মধ্যে দিয়ে আমরা ট্রেনে যাতায়াত করতাম তখন সে তার কবিতা গুলো আমাকে পরে শুনাতো। তার বাবার অসুস্থতা হয়তো তাকে ভালো খাবার থেকে বঞ্চিত করে কিন্তু তার মধ্যে শব্দ এবং অনুভূতির আলোড়ন ফোটায়। সে সবসময় তার কবিতাতেই ব্যস্ত থাকতো। ক্লাসে, ক্যান্টিনে বা আমার সাথে দেখা করার জন্য হেঁটে হেঁটে রেলওয়ে স্টেশনে আসার সময়, কখনো ট্রিওলেট , কখনো এপিগ্রাম , কখনো বা গজল ইত্যাদি ধাঁধা নিয়ে সে সবসময় জড়িয়ে থাকতো।
তার এক বাংলা শিক্ষকের কাছ থেকে সে শিখতে পেরেছিলো কিভাবে অসুস্থতাকে কবিতায় পরিণত করে উচ্ছাস প্রকাশ করতে হয়। সেই শিক্ষকই তাকে বলেছিলো কবিতার মাদ্ধমেই মানবসমাজ ঘ্রানের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারে । কবিতার মাদ্ধমেই সে মুক্তি পেতে পারে ওষুধ, সিরাপ আর ক্যাপসুলের দুর্গন্ধ থেকে যা তাকে সর্বক্ষণ ঘিরে থাকে । যে বাড়িতে ডাইনিং টেবিল আর রোগীর বিছানার মাঝখানের দূরত্বে কোনো দরজা থাকে না সেই বাড়িতে রান্না করা সম্ভব হয় না। তাদের বাড়িতে সেরকম কোনো দরজা ছিল না।
যখন গায়েত্রীর সাথে আমার দেখা হয় তখন আমি ইতিহাসের দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র। পড়াশুনায় সাধারন আমি একটি বড়ো শহরে একা একা থাকতাম। আমার বাবা জিলা স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন যিনি আমাকে এতো বড়ো শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দু – জোড়া জামা, আড়াই হাজার টাকার মাসিক ভাতা আর কবি জয় গোস্বামীর তিনটি কবিতার বই এর সাথে।
মা মারা যায় যখন তখন আমার বয়স ১৩ আর তারপর থেকে বাবার সাথে আমার যোগাযোগ হয় বাবার নির্দেশ বা জয় গোস্বামীর কবিতার মাধ্যমে। এই শহরে চলালচল করার সময় , নিজেকে খোঁজার সময় জয়দার একটি কবিতার বই সবসময় আমার ব্যাগে থাকতো। আমরা ভক্তরা তাঁকে জয়দা বলেই ডাকটাম। এই বড়ো শহরে যেখানে মনে হতো সবারই জীবন সম্পর্কে ধারণা আমার থেকে বেশি সেখানে জয়দার কবিতার বইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক এই পৃথিবীতে আমার নিজের অস্তিত্বের মতো ছিল। তুচ্ছের প্রতি আমার ভালোবাসা, রহস্যের প্রতি আমার অনুসন্ধান, অন্তর্নিহিতের প্রতি আমার তৃষ্ণা ইত্যাদির বৈধতা এনে দিতো তাঁর কবিতা। এতো বড়ো শহরে আমি একা থাকতাম যেখানে সবাই আমার থেকে বেশি জানতো কিন্তু তাঁর থেকে একটু কম। আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম, তাঁর কবিতার প্রেমে, তাঁর কবিতা থেকে আমি জানতে পেরেছিলাম যে কাউকে ভালোবাসা বা নিজের কবির বাসনা করা নিষিদ্ধ নয়। জানতে পেরেছিলাম যে আমার কলেজ শিক্ষক, বাড়িওয়ালা, নিচের চা এর দোকানের মালিক এবং আমার বাবা; তাদের জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে কিন্তু সে হারানো জিনিসগুলো এখনো আমার কবির জগতে জীবিত এবং সমৃদ্ধ হয়ে রয়েছে ।
গায়েত্রীর সাথে আমার পরিচয় হয় একটি লোকাল ট্রেনে। সে আমার পাশে বসে একটি কবিতার উপর কাজ করছিলো। আমি আমার লাঞ্চ বক্সে মনোযোগ দিচ্ছিলাম। চার বছর পর আমরা বিয়ে করে একসাথে থাকতে শুরু করি। দিনাজপুরে আমরা ছোটো রেলওয়ে কোয়ার্টারকে নিজেদের ঘর বানাই। সে মিডল গ্রেড অফিসার হিসেবে পোস্ট অফিসে যোগ দেয়। আমি লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হিসেবে রেলওয়ে তে যোগ দেই। সে প্রত্যেক সন্ধ্যায় কবিতা লিখতো আর আমি এমন প্রত্যেকটি খাবার বানানোর চেষ্টা করতাম যার উল্লেখ কোনো না কোনো কবিতায় করা হয়েছে। সুকুমার বাবু, জীবনানন্দ থেকে আজকালকার কবি যেমন শ্রীজাত এবং অনন্দিতা তাদের প্রত্যেকের কবিতা যেখানে খাবারকে হতাশা ,ভয় , লালসা বা অযৌক্তিকতার সাথে পরিবেশন করা হয়েছে।
প্রায় রাতেই সে কি লিখেছে আমাকে পরে শোনাতো। যখন সে তার সনেট, কপ্লেটস আর কীর্তন গুলো আমাকে পরে শুনাতো আমি বুঝতে পারতাম ধীরে ধীরে সে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
তার কবিতার নীরবতা তার ভেতরকার ভয়কে প্রবাহিত করছিলো যে হয়তো একদিন সেও তার বাবার মতো খিদা হারিয়ে ফেলবে, হয়তো সেও তার বাবার মতো শয্যাশায়ী হয়ে পরবে। একটি মেয়ে চুপ করে একটি পরিপূর্ণ কম্পার্টমেন্ট কে পর্যবেক্ষণ করছে থেকে কেউ একজন খুব মনোযোগ দিয়ে গ্লুকোসের ধারার গতি বিধি লক্ষ্য করছে। এই দুটো দৃশ্য যেমন খুব দ্রুত বদলে যায় ঠিক এমন ভাবেই খুব দ্রুত তার কবিতা গুলো বদলাতে লাগলো।
তার প্রেমের কবিতা গুলো দ্রুত বদলে যাচ্ছিলো উন্মাদনায়, তার আখাঙ্খা বদলে যাচ্ছিলো তিক্ততায়। সে আমার দিকে এরকম ভাবে তাকাতে লাগলো যেরকম ভাবে হয়তো তাঁর বাবা শয্যাশায়ী অবস্থায় তার দিকে তাকাতো। সে ওষুধ গুলোকে ঘৃণা করতো, ট্যাবলেট গুলো কে ছুড়ে ফেলে দিতো। এক সন্ধ্যায় ডিনার করার সময় সে আমার কাছে সে সেদ্ধ মটরের খোঁজ করে। আমি টেবিল থেকে উঠে রান্নাঘরে যাই মটর সেদ্ধ করতে আর দারুন বিরক্তি নিয়ে সে বলে উঠলো , “এটা ঘৃণার বিষয় যে, তুমি এখনো জানো না একজন কবি কি খায়। ”
সে অসুস্থ হবার পর থেকে আমি প্রত্যেকদিনই রান্না করি কিন্তু সে আর একটি কবিতাও লিখে না। তখন আমি বুঝতে পারি কী তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যখন থেকে সে কবিতা লিখা বন্ধ করে দেয় তখন থেকে আমি তাকে আর ভালোবাসিনি। আমি অন্য কারুর ভালোবাসার আকাঙ্খা করতে থাকি যে আমাকে সাহায্য করবে আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের উর্ধে যাওয়ার জন্য । কবিতার প্রতি তার ভালোবাসা আর তার প্রতি আমার ভালোবাসা একই সময় , একই সাথে কমতে থাকে। আমি বুঝতে পারি সে কোনোদিনও একজন ভালো কবি ছিল না, তার কবিতায় পরিপক্কতা ছিল না। হয়তো কবিতার প্রতি তার নিষ্ঠা ছিল তার সমসাময়িকদের থেকে একটু বেশি। ব্যাস এইটুকুই। যতদিনে আমরা দিনাজপুর পৌঁছাই, সেইই এমন একজন ছিল যার জন্য আমি রান্না করি।
আমার বাবা বুঝতে পারেন যে আমি কতটা নির্মম তাই তিনি আমাকে জয়দার কিছু শব্দের সাথে বাইরে পাঠিয়ে দেন । তিনি আমাকে কখনোই কোনো প্রতিশুতি দেন নি তাই তার থেকে আমার কখনো কোনো আশা – আকাঙ্খাও ছিল না। কিন্তু সে তো আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, আমার সাথে থাকার, কবিতা লেখার আর সেও একটি কোনো এক সন্ধ্যায় আমাকে বলে উঠলো , ” তুমি জানো না একজন কবি কি খায়। ”
আমি তাকে সেদ্ধ মোটর এনে দিলাম। সে খাবারের প্লেটটা সরিয়ে মটরের প্লেট টা নিলো, নিঃশব্দ ভাবে মটর গুলো খেলো। সেদিন আমাদের দুজনের খাবারের মধ্যে একটি সাদৃশ্য ছিল, শব্দহীনতা। তার মনে হচ্ছিলো সে আবার সেই বাড়িতে ফিরে গেছে যেই বাড়ি থেকে সে সবসময় পালাতে চেয়েছে আর আমার মনে হচ্ছিলো আমি আমার ছোটবেলায় ফিরে গেছি যেখান থেকে আমি নিজেকে উদ্ধার করতে চাচ্ছিলাম।
জয়দা ভালোবাসা সম্পর্কে অনেক লিখেছেন। লিখেছেন সেসব প্রেমিক- প্রেমিকা সম্পর্কে যাদের দেখা হয় ছোট কামরায় বা রেলওয়ে ক্রসিংয়ে, যারা মারা যায় একসাথে আত্মহত্যা করে। লিখেছেন সেসব যুগলদের সম্পর্কে যারা অন্যকাউকে বিয়ে করেছে কিন্তু কোনো একসময় তারা তাদের ভালোবাসার মানুষের সাথে গ্রাম থেকে পালিয়ে গেছে একে ওপরের হাত ধরে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে। লিখেছেন বেণীমাধবের প্রতি কিশোরীর প্রেম সম্পর্কে, লিখেছেন সেসব প্রেমিক-প্রেমিকাদের সম্পর্কে যারা সব ঝড় তুফান সহ্য করেও একজন আরেকজনকে ছেড়ে যায় নি।
সেই রাতে আমি আবার জয়দার বইগুলো একবার দেখি। পরের রাতেও এবং তারপরের অনেকগুলো রাত আমার জয়দার কবিতার বই এর সাথেই কাটে। কিন্তু সেই বই গুলোতে আমি ওই মুহূর্তটি খুঁজে পাই না যেখানে একজন বুঝতে পারে সে আর তার সঙ্গী আর একজন আরেকজনকে ভালোবাসে না। সেই প্রেমিকরা কি করে যখন তারা বুঝতে পারে যেই জায়গাটা থেকে তারা পালতে চেয়েছিলো এখন ঠিক সেই জায়গাতেই তারা দাঁড়িরে রয়েছে। জয়দা তার কবিতায় কখনো লিখেনি একজন কি করবে যখন অন্যজন কবিতা লিখে কিন্তু কবিসত্ত্বা যার মধ্যে নেই আর যে রান্না করতে ভালোবাসে তাকে যখন শুধু মটর সেদ্ধর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হয় ।
কিছু রাত খোঁজা খোঁজির পর, কিছুদিন প্রতিশ্রুতি ভাঙার পর একদিন ডিনার টেবিলে বসে গায়েত্রী হঠাৎ করে আমার দিকে তাকালো। আমি তখন খাচ্ছিলাম। সে পুরোটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে বিবর্ণ হয়ে গেছে, তার চোখ কোটরে ঢুকে গেছে আর তার চেঁয়াল হয়ে গেছে ঠিক তার বাবার মতো, উনাকে দাহ করার আগে উনার চেঁয়ালও ঠিক এরকম হয়ে গিয়েছিলো।
এক বাটি সেদ্ধ মটর তার সামনে রাখা ছিল। সে খাচ্ছিলো না, ছড়াচ্ছিল। “এরম করো না,” আমি বললাম। “পরে আমাকেই পরিষ্কার করতে হবে। ”
“তুমি আমার মার মতো কথা বলছো, ” সে বলে উঠলো। তারপর আমরা দুজনেই চুপ করে ছিলাম যেমন আমি আমার বাবার সামনে চুপ করে থাকতাম।
সে প্রচন্ড জ্বরে ভুগছিল । আমি তার মাথায় জলপট্টি দাওয়ার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু বার বার সে আমার হাত সরিয়ে দিচ্ছিলো। হয়তো সে অপমানিত বোধ করছিলো এমন কারো কাছ থেকে সেবা নিতে যে আর তাকে ভালোবাসে না, হয়তো কোনোদিন ভালোবাসেইনি।
দিনাজপুরে আমাদের রেলওয়ে কলোনির রুমে দুটি গন্ধ প্রবল ছিল, ঘাম আর ঔষুধের। আমি আমার চোখ খোলা রাখতে পারতাম না। রাগ হতো যে পরেরদিন অফিস যেতে হবে। ঘুম থেকে উঠতে হবে সকালে, খাবার তৈরী করতে হবে, তার জন্য দুপুরের খাবার তৈরী করতে হবে, ঘর পরিষ্কার করতে হবে, তাকে ওষুধ ঠিক মতো বুঝিয়ে দিয়ে অফিসে যেতে হবে। অফিসে সবাই আমার প্রশংসা করতো, আমাকে মহাকাব্যের নায়কদের সাথে তুলনা করতো। ত্যাগ আমাদের সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য। আমাদের সমাজে কেউ নিজে ত্যাগ করতে চায় না, কিন্তু সবাই চায় অন্য কেউ তার প্রতীকী হোক।
আমি মহাকাব্য পরে বড় হয়নি। কবিতায় একজন যুক্তিহীন কাজ কারবার করে। দৈনন্দিন জীবনের গতানুগতিকা যাত্রার বিষয়। প্রাচীন, বিরক্তিকর এবং গতানুগতিক। কবিতায় কষ্টের একটা আলাদা মূল্য আছে, বিশ্বাসীরা কষ্টে বিশ্বাস করে আর কবিরা বিশ্বাস করে বিষয়বস্তুতে।
গায়েত্রী বিশ্বাস করতো যে সে একজন কবি। নিজের জীবন থেকে পালানোর জন্য সে কবিতার বিষয়বস্তুতে আশ্রয় নেয় কিন্তু সে ভুল ভেবেছিলো যে সে কবিতার গঠনকে ভালোবাসে। প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে পা দেবার পর পরই সে বুঝতে পেরেছিলো কবি হিসেবে সে কতটা সীমিত। আমি বুঝতে পারি ধীরে ধীরে সে জয়দাকে ঘৃণা করতে শুরু করে, কবিতার জন্য, আমার জন্য। মূলত সে ঘৃণা করছিলো আমাদের জীবনের পুনরাবৃত্তিকে। কিন্তু পুনরাবৃত্তি একটু হলেও কবিতার জন্য প্রয়োজন। রূপক কে বাদ দিয়ে হয়তো কবি হওয়া যায় কিন্তু কবিতা লিখা যায় না।
পুনরাবৃত্তি আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোনো গানের সুর, চিত্রকল্প, সম্পর্ক, খাদ্য কোনো কিছুই পুনরাবৃত্তি ছাড়া চলতে পারে না। আমরা এটা মেনে নিতে পারিনি তাই কবিতা আমাদের জন্য ছিল না।
একদিন দেখলাম বিছানায় রাখা ট্যাবলেট, সিরাপ, ইস্ত্রি করা জামা কাপড় সব ভিজে আছে । গায়েত্রী আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রয়েছে। বুঝতে পারলাম সে বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছে। সে উঠতে পারছিলো না। আমি আমার বা হাত দিয়ে তার ডান কাঁধ ধরে খুব সামলে তাকে কোলে উঠাই। কিছুক্ষনের জন্য হলেও আমরা এক হয়েছিলাম। আমাদের জীবনটা এরকমই হয়ে গিয়েছিলো আর আমরা সম্পূর্ণ ভাবে সেটা মেনে নিয়েছিলাম।
আমি তাকে আস্তে করে পাশে ফিরাই আর তখনি আমার মাথায় এই চিন্তাটা আসে যে এই জীবনটা আমার নয়। আমি অনেক কিছু হারিয়েছি। হতাশা এবং দুঃখের সাথে বেঁচেছি এমন একজন বাবার সাথে যাকে বেশিরভাগ সময় আমার পালতে হয়েছে। গায়েত্রীর সাথেও তেমনি একটি ভবিষ্যৎ হাতছানি দিচ্ছিলো। আমি গায়েত্রীর বাবা হয়ে গিয়েছিলাম, বাবার মতো আমি গায়েত্রীকে পালছিলাম। এমন আরেকজন অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির বাবা যে একটি সন্তানোচিত সম্পর্ক তৈরী করবে সেখানে একজন যতই করুক না কেন, বাবা হিসেবে সে ব্যর্থই হবে। আমি কিচ্ছু বলিনি। আমি আমার স্পর্শ বা দৃষ্টি বদলাইনি। আমি শুধু একা একা চিন্তা করেছি , একজন মানুষের পক্ষে যতটুক চিন্তা করা সম্ভব। এমন নির্জনতায় যা আরেকজন শালীন মানুষ ভেদ করবে না। হঠাৎ সে আমার হাতটি ধরল, হাতটি তার পিঠ থেকে আলতো করে সরিয়ে দিল এবং সারারাত বিলাপ করলো। যেমন ভাবে সে আমাকে বলেছিলো যে তার বাবা বিলাপ করতো তাঁর শেষ দিনগুলোতে। আমি অবিচল চুপ করে বসে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম যেমন সে আমাকে বলেছিলো তার মা তার বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতো।
জয়দা কোনোদিন বলেন নি যে প্রেমিক- প্রেমিকাদের অতীতের কথা একে অপরকে পুরোপুরি বলা উচিত না । কিছুক্ষন পর এটা বোঝা মুশকিল হয়ে পরে কোন স্মৃতিটা আমার নিজের । কোন জিনিসটাকে একজন ঘৃণা করে, নিজের দুঃসহ ছোটোবেলাকে না অন্যজনের স্মৃতির সাথে নিজের স্মৃতিকে কে গুলিয়ে ফেলাকে।
পরেরদিন আমি চলে যাই। ব্যাগে কিছু বই আর জামাকাপড় ছিল। গায়েত্রী ঘুমোচ্ছিলো। তার পাশে রাখা দুবাটি মটর সেদ্ধ। আমি ফোন বন্ধ করে দেই। সেকশন অফিসার এর সাথে দেখা করে আমি কলকাতা চলে যাই। একটি কবিতার বই আমি গায়েত্রীর জন্য ছেড়ে যাই। এই শিক্ষাটা আমাকে বাবা দিয়েছিলো। নি:শব্দে স্মারক ছেড়ে চলে যাওয়া ।
Saranya Ganguly, 2021
এক বছরের বেশি হতে চললো , আমি রানাঘাটে আছি। তিন বছরের বেশি যে গায়েত্রী আর আমার সাথে নেই। কলকাতায় আমি রেলওয়েতেই চাকরি করতাম। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকার অনুশোচনা থেকে পালতে পারবো এই বড়ো শহরে, যদিও আমি জানতাম না গায়েত্রী মারা গেছে কিনা। আমি বাবাকে একটি চিঠি পাঠিয়ে বলেছিলাম যে আমাদের দিনাজপুরের ঠিকানায় বাবা যাতে আর চিঠি না লিখেন । তিনি উত্তরে আমাকে বলেছিলেন যে তিনি কিছু নতুন গুরুভাই খুঁজে পেয়েছেন। তিনি তার একাকীত্বতেই এখন অনেকটা স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন।
রেলওয়ে কম্পার্টমেন্টে অনেকেই উঠেন শুধুমাত্র একাকিত্ব দূর করার জন্য। ট্রেনের একঘেয়েমিতা, একই গাছ, একই বাড়ি রোজ অতিক্রম করে যাওয়া। হয়তো ট্রেনের রৈখিক ভাবে এগিয়ে চলা তাদের মনে ছাপ ফেলে , তারা হয়তো বুঝতে পারে একা হয়েও তারা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। সময় এবং দূরত্ব বয়সের একটি নিদর্শন। কে কতদিন আমাদের পাশে ছিল ? তারা কত দূর গিয়েছে? আমরা যেটা লক্ষ্য করিনা সেটা হলো একাকিত্ব কিভাবে একটা মানুষকে খেয়ে ফেলে। বছরের পর বছর, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা, বাবা থেকে প্রেমিকা, প্রেমিকা থেকে স্ত্রী, স্ত্রী থেকে সহযাত্রী। একাকিত্ব তাও পিছু ছারে না। আমরা সবাই আমাদের মতনই একা মানুষের দিকে তাকিয়ে এই ভ্রমণটা অনুভব করি। যখন দুজন নিঃস্বঙ্গ মানুষের দেখা হয় তখন হয়তো তাদের মধ্যে একটা মায়ার বন্ধন তৈরী হয়। আমরা ট্রেনে আশেপাশে তাকাই এই আশায় যে আমাদের দিকে কেউ ফিরে তাকাবে। যাদের বাড়িতে কেউ ফিরে তাকায়না তারাই হয়তো ট্রেনে আসে এমন কাউকে খুঁজতে যে তার দিকে ফিরে তাকাবে। কেউ দেখলে নিজেকে অর্থবহ মনে হয়। ট্রেন ভর্তি এইজন্য নয় যে সবাই কোথাও যাচ্ছে কিন্তু এইজন্য যে সবাই চায় কেউ তাদের দিকে তাকাক আরো বেশি করে।
একবছর পরও যখন আমি গায়েত্রীর মৃত্যু সংবাদ পাইনি, আমি ভেবেই নিয়েছি যে সে জীবিত আছে। তার মা আমাকে কোনোদিন কল দেয় নি, তার বন্ধুরা খোঁজ করে নি। কেউ কিচ্ছু জানতে চাই নি, আমি চলে গিয়েছি আর সেই সম্পর্ক সেখানেই শেষ হয়ে গেছে। হয়তো তার পক্ষ থেকেই সম্পর্কটা শেষ হয়েছে।
আমি তখন তার স্মৃতির জালে আটকে ছিলাম। প্রত্যেক দিনের ট্রেন জার্নি আমাকে তার কথা মনে করিয়ে দিতো । লাঞ্চবক্সটি তার কথা মনে করিয়ে দিতো। কবিতা তার কথা মনে করিয়ে দিতো, আর সবচেয়ে বেশি তার কথা মনে পড়তো যখন আমি রান্না করতাম।
যদিও আমি তাকে ভালোবাসিনি কিন্তু তার জন্য রান্না করেছি। আমার মতো সাধারণ মানুষের সাধারণ ভালোবাসতে আমরা ভালোবাসার মানুশের জন্য কি অনুভব করি সেটা মুখ নয়, মুখ্য হচ্ছে আমরা তাদের জন্য কি করতে পারি।
নিত্যদিনকার একঘেয়ে কাজ ছাড়াও যে ভালোবাসা দেখানো যায় সে ক্ষমতা আমার মধ্যে ছিল না। তার জন্য হয়তো ছোটবেলায় অনেক বেশি ভালোবাসা পেতে হয়। আমাকে ছোটবেলায় কেউ ভালোবাসে নি। তাই নিত্যদিনকার কাজ ছাড়া আমি কখনো তাকে ভালোবাসিনি। সেও বাসেনি।
যেই সময় আমি রান্নাঘরে যেতাম, পেঁয়াজ কাটতাম, কড়াইয়ে সর্ষের তেল ঢালতাম, লংকার ফোড়ন দিতাম আমার মন চলে যেত গায়ত্রীর কাছে। আমাদের সম্পর্কের কবিতা বুনা সে বন্ধ করে দিয়েছিলো কিন্তু আমি রান্না করা বন্ধ করিনি। ভয় হতো যে হয়তো একদিন তার সাথে দেখা হয়ে যাবে। চিন্তা করতাম তার সাথে যদি হটাৎ করে একটা লোকাল ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে দেখা হয়ে যাই তাহলে কি করবো? হটাৎ যদি লাঞ্চের সময় দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে আমার অফিসের বাইরে, ভাবছে আমি কি করে খাচ্ছি এখনো? ধরা পরে যাওয়ার ভয়টা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। যে আমার দিকে তাকানো বন্ধ করে দিয়েছে তার সম্মুখীন হওয়ার ভয়, যার আমার প্রতি কোনো প্রত্যাশা নেই তার প্রতি অভিযোগের ভয়।
আমি জয়দার কাছে ফিরে গেলাম। তার কবিতাগুলো আমার মতো মানুষে ভর্তি যারা সহজ কাজটি সহজ ভাবে করতে পারে না ,পরে পরিশীলিত অপরাধবোধে ভুগে। আমি বিশ্বাস করি কবিরা প্রতিষ্ঠা লাভ করে সাধারণের অপ্রতুলতার অভাবে ।
জয়দার কবিতায় আমার মতো লোকেরা চিরন্তন ভালোবাসার সন্ধানে থাকে, আর যখন সেই ভালোবাসা আসে তখন তারা পালিয়ে যেতে চায়। তার পাঠকদের সাথেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে। আমাদের সবাইকে নষ্ট করার মুলে হলো এই দাড়িউয়ালা পাগল মানুষটা, যে নিজে তার স্ত্রীর সাথে সম্পূর্ণ সাধারণ প্রেম করে সংসার করে যাচ্ছে কিন্তু আমাদের মধ্যে এক অসাধারণ প্রেমের বীজ বপন করে যাচ্ছে।
একদিন আমি রান্না করছিলাম। তার বই আমার পাশেই রাখা ছিল। পিছনের কভারে তাঁর একটি সুন্দর ছবি আঁকা ছিল যার নিচে লিখা ছিল তিনি রানাঘাটে থাকেন। কাকতালীয় ভাবে কিছুদিন আগে আমাদের সুপারভাইসার আমাকে বলছিলেন যে রানাঘাট রেলওয়ে স্টেশনে ডিভিশন ক্লার্কের নতুন একটি পোস্ট খালি হয়েছে।
আবার পালাবার সময় এসেছে। আমি আমার বাবার নিঃস্তব্দতা থেকে পালিয়েছি, আমার স্ত্রীর স্থির দৃষ্টি থেকে পালিয়েছি। এবার আমার শুধু একটাই যাবার জায়গা ছিল যেখানে আমার কবি থাকে।
আমি এখানে আসি একবছর আগে। আবার দু জোড়া জামা আর জয় গোস্বামীর পাঁচখানা কবিতার বই নিয়ে। রানাঘাটের রেল বাজার বিভূতিভূষণের আদর্শ হিন্দু হোটেল উপন্যাসসের দরুন অমর হয়ে আছে। আদর্শ হিন্দু হোটেলের প্রধান চরিত্র হাজারী ছোট্ট এক রেস্তোরার বাবুর্চি। যেভাবে বিভূতিভূষণ তার রান্নার বর্ণনা দিয়েছেন, তা পড়তে পড়তে অনায়াসে একজন দু- তিনবার খেয়ে উঠতে পারবে।
যখন আমি এখানে এসে জয়দার খোঁজ খবর নিলাম বুঝতে পারলাম আমাদের রেলওয়ে ডিপার্টমেন্টে কেউই তাঁর নাম শুনে নি। তারা আমাকে বলছিলো আমি মহান বিভূতিভূষণকে অন্য কেউ বলে ভাবছি যে রানাঘাটের নাম পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। যাদের বই পড়ার অভ্যেস নেই তারাই লেখকদের এরকম ভাবে মনে রাখে। তারা মনে করে সাহিত্যের কাজ হচ্ছে কোনো জায়গা বা মানুষকে উপরে তোলা।
তারা কবিদের পছন্দ করে না। কারণ কবিতায় কোনো নায়ক থাকে না। তারা এরকম গল্পই পছন্দ করে যেসব গল্পের সাথে তারা নিজেদের জীবনের মিল খুঁজে পায়, যেন কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লেখকের তাদের সম্পর্কে ভাবার সময় বা ধৈর্য আছে।
আমি তাদেরকে বার বার বুঝালাম যে আমি বিভূতিভূষণের কথা বলছি না, বরং এমন একজনের কথা বলছি যে একজন খাঁটি লেখক, একজন কবি,যার নাম জয় গোস্বামী। দুদিন আগ পর্যন্তও কেউ কিছু বলতে পারলনা, হঠাৎ করে সুখময় এসে প্রমান করে দিলো আমার জীবনের একমাত্র সঙ্গী জয় গোস্বামী।
গতকাল শনিবার ছিল। আমি বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম মাছ কিনতে। দরজায় তালা দেবার সময় একটি চিঠি চোখে পড়লো। চিঠিটা তুললাম। চিঠিটা তোলার পর প্রচন্ড ঘাম হচ্ছিলো । হাতের লেখাটা খুব পরিচিত মনে হলো। আমি বাজারের ব্যাগ নিয়ে সিঁড়িতেই বসে পড়লাম। অনেক্ষন ধরে আমি পাথরের মতো সিঁড়িতে বসে রইলাম। চিঠি খোলার শক্তি পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষন পর মনে পড়লো সুখময় আমার জন্য বাজারে অপেক্ষা করে আছে। বাজারের পর আমাদের নাপিতের কাছেও যাওয়ার কথা সেখান থেকে একসাথে দুপুরের খাবার খাওয়ার কথা । সুখময়ের বাড়ি মালদা তে , রানাঘাটে সে একাই থাকে। সে আমার রান্না খেতে অনেক পছন্দ করে। প্রায় শনিবারই চলে আসে আমার রান্না খেতে।
আমি চিঠিটা পকেটে রেখেই সাইকেল চালিয়ে বাজারে গেলাম। সুখময় আমার জন্য নাপিতের দোকানের সামনে অপেক্ষা করছিলো। আমাকে দেখা মাত্রই সে বগলের তলা থেকে একটি খবরের কাগজ বের করলো। দুজনেই খবরের শিরোনামটি দেখলাম। বড়ো করে লেখা জয় গোস্বামী আসছেন রানাঘাটের রেলওয়ে বাজার বিভূতিভূষণের উপন্যাস আদর্শ হিন্দু হোটেলের জয়ন্তী উপলক্ষে। উপন্যাসের সাথে সাথে তিনি উপন্যাসসের খাবার নিয়েও আলোচনা করবেন।
“এইতো তোমার সুযোগ এসেছে,”- সুখময় বললো। “তার জন্য কিছু রান্না করে নিও, তুমি তো আর তাঁর সাধারণ ভক্ত নও। আমি নিশ্চিত তোমার খাবার খেয়েই উনি তোমার বন্ধু হয়ে যাবে।”
আমি সুখময় থেকে খবরের কাগজটি নিলাম। আমরা চুল কাটালাম। আমি তাকে বললাম যে আমার ভালো লাগছে না, আমার শরীরটা ভালো নয়। আমি বাড়ি পৌঁছেই চেয়ারে বসে পড়লাম। চিঠিটা তখনও আমার পকেটে, খোলা হয়নি। আমার হাতে বাজারের খালি ব্যাগ আর খবরের কাগজ।
কিছুক্ষন পর আমি চিঠিটা খুললাম। হাতের লেখাটি গায়েত্রীর । ভুল হবার কথা নয়। সে একটি রান্নার রেসিপি পাঠিয়েছে। আমি জানি আমি বহিস্কৃত হয়েছি। এখন সে রান্না করে, নিজে নিজে। আমি আমার রুমের চারপাশটা দেখলাম। একবছর হতে চললো অথচ আসবাব পত্র বলতে শুধু একটি চেয়ার। যখন সুখময় আসে তখন কি হয় ? সে কোথায় বসে ?
খেয়াল করি যে রান্নাঘরে একটি চেয়ার আছে। এই চেয়ারটি এই বাড়ির সাথেই ছিল। যার উপরে আমি একটি সবজির বাক্স রেখেছিলাম। আমি চেয়ারটি থেকে বাক্সটি নামালাম। কিছুক্ষন রান্নাঘরটি তাকিয়ে দেখলাম, ভাবলাম কবি সচরাচর কি খান ? তার কবিতা পরে আমরা তার স্কুল, তার ছোটবেলা, তার অফিস সম্পর্কে জানতে পেরেছি। জানতে পেরেছি অফিস যাওয়ার সময় রাস্তাটা উনি নেন, কোন ট্রাম- বাস – ট্রেনে তিনি চড়েন। কিন্তু তার রান্নাঘর সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তার রান্নাঘরে বাসন- কোসন, পেঁয়াজ কাটা আর মাছ ভাজার কিরকম আওয়াজ হয় তা আমি জানি না।
তিনি আর তাঁর স্ত্রী কি একসাথে রান্না করেনা ? তিনি কি এখন এতটাই সন্তুষ্ট যে তিনি আর একাকিত্ব বোধ করেন না, একাকিত্ব নিয়ে লিখেন না ? যখন তার খিদা লাগে তখন কি তিনি খাতা কলম নিয়ে বসেন ? কিছু লিখতে না পারা পর্যন্ত তিনি কি নিজেকে অভুক্ত রাখেন ?
আমি রান্নাঘর থেকে চেয়ারটি নিলাম এবং টেনে সেটিকে লিভিং রুমে আনলাম। আমার চেয়ারটির সামনে এই চেয়ারটিকে রাখলাম। গায়াত্রীকে ছাড়ার পর প্রথমবারের মতো আমার একটি নিজস্ব রুম হলো যেখানে দুজন সামনা সামনি বসতে পারবে। দুজন অভুক্ত মানুষ, যারা খুবই ক্ষুধার্ত।
আমি তখনও জানি না তিনি কি খান। আমি তখনও জানি না তাঁর সাথে দেখা হলে আমার একাকিত্ব কমবে কিনা। আমি গায়েত্রীর রেসিপিটা পড়লাম। সে সব উপাদান লিখে রেখেছিলো কিন্তু উপাদানের পরিমাপ সম্পর্কে কিছু লিখে নি।