লেখক নয়, আমি নিজেকে বলে থাকি লেখোয়াড়। সেই যেমন লোকে খেলতে খেলতে খেলোয়াড় হয়ে যায়- কোন তালিম ছাড়াই লিখতে লিখতে আমি হয়ে গেছি লেখোয়াড়। তবে লেখোয়াড় হবার আগে ছিলাম রাঁধুনি । তাঁর আগে রিকশা চালক । তাঁর আগে যে আরো কত কী !
Artworks © Amritah Sen
একটা বিচ্ছিরি বিচিত্র- জঘন্য জীবন আমার । সেই জীবন আমাকে ঠেলতে ঠেলতে কত জায়গায় যে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে তাঁর কোন ঠিক ঠিকানা নেই। লেখাপড়া জানতাম না , বাবার ক্ষমতা ছিলনা পাতে দুটো ভাত আর হাতে একটা বই দিয়ে ‘ইশকুলে’ পাঠায় । তাই প্রান বাঁচাবার জন্য-পেট ভরাবার জন্য যখন যে কাজ পেতাম-করতে বাধ্য হয়েছিলাম। মুটে মজুর রিকশাওয়ালা ডোম সুইপার ট্রাকের খালাসি নৈশপ্রহরী- এক সময় কমিশনে অনাথ আশ্রমের জন্য ভিক্ষাও করেছি।
শিশুকাল পার হয়ে একেবারে বালকবেলা- যখন আমি ঘুমঘোরে বিছানায় প্রস্রাব করে ফেলতাম তখনই আমার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ছাগল গরু চড়ানো দিয়ে-। তারপর চায়ের দোকানের চাকর। না না এত ভয় পাবার কিছু নেই। আজকাল লোকে এক চাওয়ালার কীর্তিকলাপে ভীত ত্রস্ত আতংকিত । আমি তেমন ভয়ানক জীব নই। আমি চা বানাইনি, বেচিওনি । মাত্র চায়ের দোকানে কাজ করতাম- এঠো গেলাস ধুতাম।
চা বেচবার মত দক্ষতা যোগ্যতা থাকলে আজ দশলাখ টাকা দামের স্যুট পরতে পারতাম, দেড় লাখ টাকা দামের মাশরুম খেতে পারতাম । সাড়ে আট হাজার টাকা দামের সর্বসুবিধা যুক্ত এরোপ্লেন চড়তে পারতাম।পনেরো হাজার কোটি টাকা দিয়ে নির্মিত হতো আমার বাসভবন । সামনে পিছনে ছুটতো হাজার হাজার কর্মচারী। পঞ্চাশ লক্ষ টাকা মাইনের একদল বিউটিসিয়ান আমাকে সাজিয়ে দিতো- যখন যেমন সাজ দরকার- সেই সাজে । মনের আনন্দে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতাম- লাল পরী নীল পরীরা আমাকে ঘিরে থাকতো। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হতো আমার সুখের সন্ধানে-। মাত্র সামান্য ভুলে ফস্কে গেছে জীবনের এত সব প্রাপ্তি।
সেই যখন আমি সবে কৈশোর পার করে একটু যুবক মতো হয়েছি- রাজমিস্ত্রির সঙ্গে জোগাড়ের কাজে যেতাম । সকাল হলে একটা মোড়ের মাথায় কাজের সন্ধানে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম। আমি একা নয়- গ্রাম বাংলার নানা জায়গা থেকে আরো শত মজুর এসে ভিড় করতো কাজ পাবার আশায়। আমাদের দেশে সবদিন কর্মপ্রার্থীর তুলনায় কাজের পরিমান কম । ফলে সবদিন সবার কাজ হতো না। যেমন ভাবে গরুহাটায় গিয়ে লোকে টিপে টাপে দেখে কোরবানীর তাজা তাগড়া গরু কেনে- সেই ভাবে মিস্ত্রিরা এসে আমাদের পরখ করে দেখে কত কম মজুরি দিতে পারে – দরদাম করে কাজে নিয়ে যেতো।
একদিন আমার সামনে এসে দাঁড়ালো একজন লোক। আহা মরি মরি ! কী তাঁর নধর কান্তি ! মাথার লম্বা কীর্তনীয়া মার্কা চুলে চপ চপ করছে সরসে তেল । ফাটাচটা পদযুগলে কোন চপ্পল নেই, গায়ে ফুল হাতা সাদা গেঞ্জি । যার উপরে হলুদের ছিটে ছিটে দাগ। গায়ের গেঞ্জি ভেদ করে ফুটে উঠেছে গলায় বাঁধা মোটা পৈতাখানি। যা দেখে মনে হচ্ছে যেন অর্ডার দিয়েই বেশ শক্ত পোক্ত মজবুত করে ওটি বানানো । চাইলে এই পৈতা দিয়ে গরু বাঁধা যাবে। মরতে শখ হলে গলায় দিয়ে ঝুলে পড়তেও পারবে। মুখে দাত দুটো কম আছে তবে সেই মুখেই সকাল সকাল ঠুসে দিয়েছে একখানা জর্দাপান। যার গন্ধে বাতাস ভুর ভুর করছে। সে সোজা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে- এই, মোর লগে কামে যাবি ?
কাজে যাবার জন্যই তো সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছি। কেউ আমাকে কাজে নিয়ে যাবে, দুপুরবেলায় সেই কাজের বাড়ি থেকে কিছু পয়সা চেয়ে নেবো , তবেই তো আমার দুপুরের খাবার জুটবে। বিকেলে বাকি মজুরি নিয়ে বাজার করে বাসায় গেলে মা বাবা ভাই বোন কিছু খেতে পাবে। জিজ্ঞাসা করি, কী কাজ ? সে জানায়- বিয়া বাড়ির কাম । টিউবয়েল থেকে জল এনে ড্রামে ভরতে হবে, শিল নোড়ায় ফেলে মশলা পিশতে হবে। কলাপাতা মাটির গেলাস ধুতে হবে। খাবার পরে এঠো পাতা তুলে ফেলতে হবে।
এটা যে সময়ে কথা সে সময় মিক্সি মেশিন ছিলোনা, দোকানে গুড়ো মশলা কিনতে পাওয়া যেতো না। অতিথিরা কাগজের থালায় খেতে অভ্যস্ত হয়নি। আর তখন আজকের মত কেটারিং ব্যবস্থাও চালু হয়নি। কোন অনুষ্ঠান হলে গৃহকর্তা নিজে বাজার করে- রান্নার লোক এনে রান্না করে, নিজের লোক দ্বারা পরিবেশন করিয়ে অতিথি সেবা করতো।
পরিবেশনের কাজে বয়স্কদের চাইতে যুবাদের উৎসাহ অনেক বেশি দেখা যেতো । মাংস মিষ্টির বালতি নিয়ে যুবতীদের সামনে ঘুর ঘুর আর বিনয়ে বিগলিত হতে দেখা যেতো- আর এক টুকরো মাংস দিই তোমাকে ? রসগোল্লাটা খেয়ে দেখো খুব ভালো । আসল ভীম নাগের…।
কথায় বলে পাকস্থলিতে পৌছাবার আগে নাকি হৃদয়ের পথ পড়ে । যুবজনের আতুরতা দেখে যে কেউ বুঝে নিতে পারতো যে সে মনে মনে আবেদন জানাচ্ছে- একটু জায়গা দাও তোমার হৃদয়েতে বসি।
জানায় সেই নধরকান্তি লোকটা- তিন টাকা মজুরি পাবি । আর তার সঙ্গে এক পেট উপদেয় খাবার । মাছ মাংস দই মিষ্টি – কোন বারন থাকবে না । যতক্ষন পেটে ধরবে ঠেসে খেতে পারবি । খেতে না চাইলে খাবারটা গামছায় বেঁধে নিয়েও যেতে পারবি।
এই প্রসঙ্গে অনেকদিন পরের একটা কথা মনে পড়লো। আমরা যার সঙ্গে রান্নার কাজে যেতাম তার নাম নরেশ ঠাকুর । নরেশ ঠাকুরের আর একজন জোগাড়ে ছিল তার নাম দুঃখে । এমনিতে জনমজুরের কাজ করতো- উপাদেয় খাবারের লোভে সেও রান্নার জোগাড়ে হয়ে গিয়েছিল। আট ঘন্টা কাজের যে মজুরি ষোল সতেরো ঘন্টা কাজ করে সেই মজুরি পেয়েও খুশি ছিল ।
যখন কোন বাড়িতে অনুষ্ঠান হতো গৃহকর্তা আগে ভাগে এসে নরেশ ঠাকুরের কাছ থেকে কোন জিনিস কতটা কিনতে হবে তাঁর একটা ফর্দ বানিয়ে নিয়ে যেতো । ফর্দ অনুসারে কেনা কাটা করতো। সেই মতো সেবার নরেশ এক গৃহকর্তাকে ফর্দ বানিয়ে দিয়েছিল ।
আজকালের মতো মানুষ তখনো এত স্বাস্থ্য সচেতন হয়নি । মেপে মেপে খেতে শেখেনি । যে খুব বেশি খেতে পারতো লোকে তাকে বিশেষ ভাবে যত্ন নিতো। আরো খাও আরো খাও বলে উৎসাহিত করতো।
নরেশ হিসেব করে ফর্দ দিয়েছিল-মুগ ডাল শতকড়া আড়াই কেজি । অতে মাছের মাথা পড়বে তো ! অনেক বেড়ে যাবে। মাংস একশো লোকের জন্য কুড়ি কিলো।মাছ মাথা পিছু চার পিস। দেখবেন যেন মাথা বাদ দিয়ে কেজিতে ষোল পিসের চেয়ে কম না হয়। রসোগোল্লাও ওই চার পিস । কেউ পাঁচ পিস খাবে কেউ তিন – গড়ে চার পিস হলে ম্যানেজ হয়ে যাবে।
রাতে সবার খাওয়া দাওয়া হয়ে যাবার পর সেদিন খেতে বসেছিল রান্নার “ঠাকুরেরা”। অনেক দুরের পথে বলে তারা খাবারের পোটলা বেধে নিয়ে যেতে উৎসাহী হয়নি। যতটা পারে পেটে করেই বয়ে নিয়ে যাবার ইচ্ছা।
আমি একবার মজুরে খাটতে খাটতে কলকাতা থেকে পালিয়ে জলপাই গুড়িতে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে এক মিষ্টির দোকানে কাজ পেয়েছিলাম। কোন মাইনে নেই- শুধু খাওয়া ! যখন মজুর খাটতাম আড়াইটাকা মজুরি পেতাম । এখানে কোন মাইনে মিলবে না । অর্থাৎ এরা আমার অসহয়তার সুযোগ নিয়ে আমাকে ঠকাচ্ছে । কিন্ত আমি তো জেনে বুঝে ঠকতে পারবো না । বাধ্য হয়ে তখন গুনে গুনে দশটা সন্দেশ রসোগোল্লা কালাকাঁদ চমচম খেয়ে ফেলতাম। চার আনা করে একটা মিষ্টির দাম । এ ভাবে আমি আমার মজুরি বুঝে নিতাম।
জন মজুর খাটা মানুষের আটঘন্টার মজুরি তিন টাকা। রান্নার কাজেও মিলবে সেই তিন টাকা । অথচ খাটতে হবে ডবল সময় ধরে । কী আর করবে বেচারারা ! তারা তাদের বাড়তি আট ঘন্টা কাজের মুল্য খেয়ে খেয়ে শোধ- পরিশোধ করে নেয়। মেঘা দাস গালের একদিকে পান পুরে চিবোতে চিবোতে অন্য গালে ফেলে মাছ মাংস কাজু কিসমিস খেজুর খেয়ে নেবার মতো কলা জানে । শতেক পাহাদার চোখের সামনে মুখ নড়বে কিন্ত কেউ বুঝতে পারবে না পান খাচ্ছে না অন্য কিছু।
বাবুলোকেরা অনেকদিন ধরেই জানে আর বিশ্বাস করে যে এই সব রান্নার লোক এক একটা আস্ত চোর। একটু ফাঁক পেয়েছে কী কিছু একটা মুখে গলিয়ে দেবে। তাই তারা তীক্ষ্ণ চোখওয়ালা একজনকে রান্না শুরু হওয়া মাত্র চেয়ার পেতে রান্না ঘরের সামনে বসিয়ে দেয়। খুব শান্ত আর নিরীহ ভাষায় বলে সে- না না আমি কোন পাহারা দিতে এখানে বসিনি। যদি কেউ ভাবে চুরি করবে- তাকে আটকানোর ক্ষমতা কারো নেই। আমি বসে আছি কারন এই সব রান্না বান্না দেখতে আমার খুব ভালো লাগে । বলা বাহুল্য রান্নার লোক কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করে না । তবু তারা হেসে বলে- পাহারা দিলেও আমাদের কোন ব্যাপার নেই। আমরা ও সব চুরি ফুরি করিনা ।
সেদিন ওই বাড়িতে রান্না হয়েছিল মাছের কালিয়া । তাজা টাটকা কাতলা মাছ- যার অপুর্ব স্বাদ । অনেকদিনের না খাওয়া মুখ আর পেটে দুঃখে সেই মাছ সাত পিস খেয়ে ফেলেছিল। খাবার শেষ হবার পর মুখ হাত ধুয়ে নরেশ গৃহকর্তার সামনে গিয়ে হাত পেতেছিল- দিন কত্তা আমাদিগের মজুরিটা দিয়ে দিন । রাত অনেক হলো, এবার আমরা বিদায় হই।
Artworks © Amritah Sen
ওখনই দেওন লাগবো ? সকালে আইয়া নিতে পারবা না ?
সকালে আসতি গিলি এট্টাদিন নষ্ট হয়। খানিক বাস ভাড়াও যায়। এখন দিয়ে দিলি আর ঝামেলা থাকে না।
মালিক ঘরে ঢুকে মজুরি নিয়ে এসে মিটিয়ে দেবার সময় গুনে দেখে নরেশ- দু টাকা কম । জানায় সে- বাবু দু টাকা কম আছে।
না কোন কোম নাই । এক্কারে হিসাব কইর্যা পাই পাই মিটাইয়া দিছি । বলে বরিশাল জেলার মজুমদার বাবু তাঁর নিজস্ব বাঙাল ভাষায়- চারজন জোগাইড়ার ষোল টাকা আর তোমার হইলো গিয়া আট টাকা । তাইলে –মোট খাড়াইলো চব্বিশ টাকা । যার মইধ্যে তোমারে পাঁচ টাকা বায়না নেওয়া আছিল, তাইলে বাকি থাকছে গিয়া ঊনিশ টাকা । তোমার এক জোগাইল্যা তিনখান মাছ বেশি খাইছে।তাঁর দাম দুই টাকা কাইট্যা সতেরো টাকা দিছি । গুইন্যা নাও-।
মিন মিন করে বলে নরেশ – এ কী কথা ! আমরা তো সব জায়গায় ‘ফিরিতে’ খাওয়া পাই! তাঁর দাম…।
রাগত গলায় বলে মালিক- তুমিই তো হিসাব দিছিলা মাথা পিছু চাইরখান । তাইলে হে কোন আক্কেলে সাতখান মাছ খাইছে ! ফকটিয়া পাইলাম বইল্যা কোন হিসাব কইর্যা খামুনা ? এট্টা শিক্ষা দিয়া দিলাম । এরপর থিকা খাওয়ার সোমায় এট্টু বুইঝা সামঝাইয়া চলবে।
দুটাকা ফেরত পাবার আশায় আবার বলে নরেশ– সবার তো খাওয়া দাওয়া হয়ে গিছিলো । অনেক বেশি বাঁচাখোঁচা ছিল তাই…।
বাঁচা থাকুক আর খোঁচা- থাকলে আমার থাকবে- তাইতে তোমার কী ? মাইনষেরে দিই কী কুত্তারে- আমি তারে যা পারমু তাই করমু । হেইডা দেখা তোমাগো কাম না । কথা শেষ করে মালিক বাবু সোজা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল ।
আমার সেই সদ্য চোখে আলো ফোটা জীবনে কথিত বাবু ভদ্রলোকেদের মন মানসিকতার এমন পঁচাগলা দুর্গন্ধ যুক্ত ছবি দেখে- সারা শরীর রাগে রিরি করে উঠেছিল । পরবর্তী সময়ে আমাকে এই রাগ ঘৃনা তাদের সম্মন্ধে সজাগ আর সাবধান থাকতে শিখিয়েছিল ।
আমি দেশভাগ জনিত কারনে উদ্বাস্তু এক পরিবারের সন্তান । উপাদেয় খাদ্য তো অনেক দূর বহুদিন আমাদের পেট ভরে খাবারই জোটেনি। বাবা জনমজুর খেটে আগে কিছু আনতে পারতেন। এখন গ্যাষ্ট্রিক আলসারে কাতর। আর কাজে যেতে পারে না। আমি যা রোজগার করি তাতেই খেয়ে না খেয়ে কোনমতে সংসার চলে। দিনের শেষে যা মজুরি পাই খুঁদ না হয় আটা ভুট্টা এই মাত্র কিনতে পারি। তা-ও কোনদিন নুন জোটে তো সবজি থাকে না । ফলে এই রকম স্বাদু আর লোভনীয় কাজে যাবো না- বলতে পারিনা। অন্য কাজে গেলে আটঘন্টা ‘ডিউটি’ । এই কাজে সময় দিতে হবে সকাল সাতটা থেকে রাত বারোটা- একটা । তবু রাজী হয়ে যাই।
সেই যে বলে জীবনের ধন কিছুই যাবেনা ফেলা। কে তখন জানতো আজ যে রান্নার কাজে যাচ্ছি আজ যা শিখবো তা আগামী জীবনের কাজে লেগে যাবে। অনেক বছর পরে আজ রান্না নিয়ে লিখতে বসেছি সে তো সেই সেদিনের দান। যদি সেদিন রান্নার কাজে না যেতে পারতাম- আর কিছু না হোক এই লেখাটা কী লিখতে পারতাম ?
আমি ভারতীয় বর্ন ব্যবস্থায় সবচেয়ে নিচের যে ধাপ সেই অচ্ছুত অস্পৃশ্য নোমো জাতির সন্তান। যারা জন্মজনিত কারনেই ঘোষিত অপরাধী। আমার জাতির মানুষ যদি কোন উঁচু জাতির খাবার ছুঁয়ে দেয় সেটা ঘোর অপরাধ বলেই বিবেচিত হয়। যে আমাকে কাজে নিয়ে যেতে এসেছে সে-ও অচ্ছুত অস্পৃশ্য জেলে জাতির মানুষ। কোনো উপায় নেই, রান্নার কাজে তাকে তো যেতেই হবে। কারন স্বাদু খাবারে তারও লোভ। অনেক ভেবে চিন্তে সে একটা উপায় বের করেছে । একটা গুরু ধরেছে। যে গুরুর শিষ্য হলে পাওয়া যায় একটা মহামুল্য উপহার। সে তাঁর সব শিষ্যকে গলায় একটা করে পৈতা পরিয়ে দেয় । পৈতার লোভে তাঁর শিষ্য সংখ্যা খুব বেড়ে যাচ্ছে।
গলায় পৈতা থাকলেই লোকের ধারনা হয়- নিশ্চয় বামুন । এই কারনেই উড়িষ্যা থেকে যারা কলকাতায় রান্নার কাজ করতে আসে- তারা ট্রেন থেকে নেমেই হাওড়া ব্রীজের উপর থেকে একটা মোটা পৈতা কিনে গলায় গলিয়ে নেয়।
আমাকে যে কাজে নিতে এসেছে তাঁর নাম মেঘা দাস। পৈতে প্রদানকারী গুরুর শিষ্য হয়ে পেশাগত দিক থেকে কিছুটা স্বাবলম্বী হতে পেরেছে। আর তার কী জাত কেউ জানতে চায় না। মাত্র একবার একজন- কিরে তুই বেরাম্মন ! কবে হইলি? গায়ত্রী মন্ত্র জানিস ? বলে খুব হেসেছিল।
এখন আমার কাছে সে জানতে চায়- তোর কী নাম রে ? নাম শোনবার পরে বলে- যদি তোরে কেউ নাম জিগায়- এই পদবি কবি না। নাম কবি যা তোর মোন চায়- জাইত কবি কাইস্থো । কোনো মতে কাম কইরা পয়সা নিয়া চইল্যা আইতে পারলে জাইত যাউক সোগা মাড়াইতে।
সেই কতকাল আগে শুনেছিলাম, কারো পৌষ মাস আর কারো সর্বনাশ! সেদিন কথাটার যে কী মানে- বুঝতে পারিনি। অনেক সময় আমরা অনেক কথা শুনে থাকি বটে কিন্ত সব সময় সব কথার মানে বোঝা যায় না । বুঝিয়ে দেয় কোন এক সময় ! সময়ের চেয়ে বড় শিক্ষক আর কেউ নেই।
সেদিন আমরা যে বাড়িতে রান্নার কাজে গিয়েছিলাম আয়োজন ছিল চারশোজন অতিথি অভ্যাগতের । সারাদিন তো কোন সাড়া শব্দ ছিলো না- কিন্ত রান্নাবান্না যখন আমাদের প্রায় শেষ ঠিক সেই সময়- সন্ধ্যাবেলায় প্রবলবেগে জনজীবনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কালবৈশাখীর প্রবল ঝড়। এক একটা জলের ফোটা পড়ছিল আধলা ইটের টুকরোর মতো। ঝড় বাতাসের আঘাতে বড় বড় গাছের ডাল হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ছিল রাস্তার উপরে। তীব্র আলো আর বিকট শব্দ করে বাজ পড়ছিল চারদিকে। যানবাহন চলাচলের কোনো উপায় ছিলনা । সমস্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ঘন ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছিল সবখানে।
দেড় দু ঘন্টা পরে যখন বৃষ্টি থামলো রাস্তার উপরে থৈ থৈ করছে জল। রাস্তা আর পাশের ডোবা সব একাকার। সে সময় পথঘাট আজকের মতো এত উন্নত ছিলনা। জল নিকাশী ব্যবস্থাও ছিল খুব খারাপ। যে পাড়ায় আমরা গেছি সেখানকার ইট বেছানো রাস্তার উপরে ছিল বড় বড় গর্ত । এই রাস্তায় রিকশা ছাড়া অন্য কোন বাহনও চলত না। সেই রাস্তায় বড় বড় গর্তে জল জমা হয়ে যাওয়ায় আর এখন কোন রিকশায় আসতে চাইছে না। গর্তে পড়ে চাকা ভেঙ্গে যাবার ভয়। ভয় আরোহীদেরও। চাকা ভেঙ্গে উলটে পড়লে কাদামাটিতে সব সাজ সজ্জা লেপটে যাবে। আহত হয়ে হাসপাতালেও যেতে হতে পারে।
এমত অবস্থায় যারা কিছু দূরে থাকে সেইসব আমন্ত্রিত আত্মীয় অতিথিরা আসবে কী করে? তা ছাড়া এইসব অঞ্চলে তখন রাত নামলেই দুইদল মাস্তানের মধ্যে শুরু হয়ে যেতো এলাকা দখলের লড়াই। ব্যাপক বোমা পড়তো- গুলি চলতো। যে ভাবে হোক অতিথিরা যদি বা আসতে পারে অক্ষত ফিরে যাবে তার কোন গ্যারান্টি ছিলোনা। ফলে নিমন্ত্রিত চারশো জনের মধ্যে মাত্র এসেছে দুশো আড়াইশো লোক । গৃহকর্তার মাথায় হাত- অবশিষ্ট এত খাবার দাবারের এখন কী উপায় হবে !
সে সময় ফ্রীজ নামক বস্তুটির আবিষ্কার হয়নি। মোড়ের রকমারী দোকানের সামনে একটা বড় লোহার বাক্সে বরফের মধ্যে কোকাকোলা সোডাজল ঢুকিয়ে রেখে ঠাণ্ডা করে বিক্রি করার চল ছিল।
ফ্রীজ থাকার যে সুবিধা তার অন্য একটা অসুবিধাও আছে । এক বিয়েবাড়িতে আমরা দুজন লোক কাজে গিয়েছিলাম । বিয়ের আগে একদিন আর বিয়ে ও তাঁরপরের দু চার দিন কাজ করার কথা ছিল আমাদের । মূল যে অনুষ্ঠান সেদিনের রান্না আমাদের করতে হবে না । সে করবে আমাদের চাইতে বড় আর এক নাম করা রাঁধুনি। আমরা করবো টুকটাক- অন্য তিন চার দিনের জন্য সাধারন রান্না। সেই মূল অনুষ্ঠান যেদিন হলো– অবশিষ্ট সব খাদ্য এনে ঢোকানো হলো ফ্রীজে । রাধা বল্লবি, মাংস মাছ চাটনি ফিসফ্রাই । পরে আর যে কয়দিন আমাদের ওখানে থাকতে হয় সব কয়দিন খেতে হলো সেই ফ্রীজে রাখা খাবার গরম করে করে। বাড়ির লোকেদের জন্য বাজার আসছিল তাজা টাটকা চারাপোনা, কইমাছ, সরুচাল । রান্নাও করছিলাম আমরা। কিন্ত আমাদের খাবার সময় এলেই বাড়ির গিন্নি ফ্রীজ থেকে বের করছিলেন চারদিন আগের জমিয়ে রাখা খাবার ।
যারা এই সব কাজে আসে বাড়ির লোক সন্দেহ করে তারা চুরি করে খেয়ে নেয়। সেটা একেবারে মিথ্যাও নয় । খাবার জিনিসে সবার লোভ হয়। রান্না করতে এসেছে বলে মনটাকে তো মেরে ফেলতে পারেনি। কিন্ত চাইলে তো কেউ দেবেনা । অগত্যা চুরি… ।
একবার এক অনুষ্ঠান বাড়িতে আমরা কাজে গিয়েছিলাম। লোভের বশবর্তী হয়ে- অথবা খিদের তাড়নায় একজন চায়ের জন্য এনে রাখা পাউডার দুধ মুঠো করে মুখে পুরে দিয়েছিল। আর যায় কোথায় তাড়াতাড়ি গিলতে গিয়ে সে দুধ গলায় আটকে চোখ উল্টে প্রায় মরো মরো অবস্থা।
মিথ্যে বলবো না – আমিও একবার চুরি করে ভাজা মাছ , চুমুক দিয়ে ঘী , আধা সেদ্ধ মাংস, কাজু কিসমিস নারকেল , অনেক কিছু খেয়েছিলাম। সে বাড়িতে কাজে গিয়ে জানলাম- যেহেতু আগে ভাগে বলে কয়ে নেওয়া হয়নি তারা আমাদের দুপুরের জন্য কোন খাবার দিতে বাধ্য নয়। জানিয়ে ছিলাম আমরা, এটা তো কাউকে বলার দরকার কোনদিন হয়নি তাই বলিনি। না বলতে বলতে ধারনা হয়ে গেছে , এমনিতেই পাওয়া যাবে। বলে তারা, সেটা আমাদের ভুল বা দোষ । তারা আর কী করবে ! যে হেতু খিদে লাগলে আমার মাথার কোন ঠিক থাকেনা । ন্যায় অন্যায় জ্ঞান থাকেনা। ফলে খিদে চাপা দিতে যা করতে হয় –নির্দ্বিধায় করে ছিলাম।
সে যা হোক – সেদিন কাজের শেষে আমরা নিয়ম মতো যে যার গামছা পেতে তার উপর কলা পাতা বিছিয়ে মালিকপক্ষের কাছে জানিয়ে ছিলাম- এখন আমরা খেতে পারবো না । বাড়ি যাবো-খানিক বিশ্রাম নেবো। চান ফান করে তবেই খাবো। আমাদের যেটুকু খাবার পাওনা হয় কলাপাতার উপর দিয়ে দিন । বেঁধে ছেঁদে নিয়ে যাই। গৃহকর্তা আমাদের সামনে এসে দুঃখী গলায় বললেন – আর কী দেবো থোবো । যা তোমাদের দরকার, যতোখানি ইচ্ছা নিয়ে যাও। এসব আর কী হবে ! সব তো ফেলাই যাবে। যা পারো নিয়ে কমাও।
“আপনা হাত জগন্নাথ” । আমাদের যার গামছায় যতখানি বাঁধা যায় ইচ্ছামত বেঁধে নিয়েছিলাম সেই খাবার । সেদিন আমাদের বাসায় সেই রাতে যেন উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঘুম থেকে তুলে মাবাবা ভাইবোনের সামনে যখন গামছার পুটুলি খুলেছিলাম তারা খাবার দেখে যেন পাগল হয়ে গিয়েছিল । আমার তখন খুব দুঃখ হয়েছিল । এত খাবার নষ্ট হয়ে গেছে , বেচারা মালিকের খুব ক্ষতি হয়ে গেছে , দুঃখ সে জন্য নয় ! দুঃখ- অন্য অনেকের চেয়ে আমার গামছাটা বেশ ছোট ছিল ।
পরে আর একবার এই রকম অঢেল খাবার পেয়েছিলাম। মাংস আর পোলাও । বাড়ির মালিক আমার পুর্ব পরিচিত বলে একটা পিতলের বালতি– ‘কাল সকালে ফেরত দিয়ে যাবো’ বলে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। সেই বালতিতে ঠেসে ভরেছিলাম মাংস পোলাও । অত খাবার একারা খাওয়া যাবে না । আর সুখ নাকি সবার সঙ্গে ভাগ করে নিলে বেড়ে যায় , সেই জন্য আশেপাশের এক দুটি দরিদ্র মানুষকেও বিতরন করেছিলাম।
সুখ বলে একটি ছেলে- যার মাকে আমি খুড়িমা ডাকতাম, সে খুব আনন্দ করে খাচ্ছিল আর বলছিল– আমাগো খাওয়ার অভ্যাস আছে। যারা কোনদিন খায় নাই তারা ঘী খাইয়া সহ্য করতে পারবে না। দেখা গেল সেই খুড়িমা পরেরদিন বার বার মগ নিয়ে পাশের জঙ্গলের দিকে দৌড় মারছে। আর আমাকে গাল দিচ্ছে । তাঁর কোন দোষ নেই- সব দোষ আমার আনা খাবারের-।
আমাদের দেশ মুনি ঋষিদের দেশ । বড় পুন্য এখানকার মাটিতে। স্বয়ং ভগবান পর্যন্ত এই মাটির টান অস্বীকার করতে পারে না । তাই বার বার অবতার হয়ে জন্ম নিতে ছুটে আসেন । দেখার ব্যাপার এটাই যে পৃথিবীতে আরো দুশো উনিশটা দেশ আছে। কোন দেশকে ভগবান এত পছন্দ করেনি। আর কোথাও অবতার হয়ে জন্মায়নি। শুয়োর হয়ে- কচ্ছপ হয়ে- অর্ধেক মানব অর্ধেক পশু –মানে নৃসিংহ অবতার হয়ে এখানেই বাস করতে এসেছেন । যার পরিনাম এই – দেশে মহাপুন্য ছেয়ে গেছে। এত সাধু সন্ত এখানে ধরছে না বলে কিছুজন জেলখানাতে গিয়ে বাস করতে শুরু করছে । ফলে জেলও হয়ে গেছে গেছে সাধুর আখরার মতো ।
এই সব সাধু সন্ত মহাজনেরা মানুষকে কত সদোপদেশ দিয়ে গেছেন। ভগবান মানব সমাজের জন্য যা কিছু বানী উপদেশ সব দিয়েছেন সংস্কৃতে । তার এটা বোঝা উচিৎ ছিল এই দেশের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর । তারা সংস্কৃত ভাষা বুঝবে না। পৃথিবীর সাড়ে সাতশো কোটি মানুষের বোধ্য যে ভাষা তেমন কোন একটা ভাষায় বানী দিই। জাড়োয়া মুড়িয়া মুন্ডা সাওতাল সবাই যাতে বুঝতে পারে। কেন যে সেটা করেনি আমার বোধের অতীত ।
ভগবানের যারা ভক্ত, প্রচারক- তারাও সব ওই সংস্কৃতে বাক্য বানী দেয়। ওনারা বলে গেছেন – নির্লোভ হও । কখনো লোভী হয়ো না । জানবে লোভে পাপ আর পাপে জীবতকালে নরকবাস হয়। তাদের কথাও সাধারন মানুষের কাছে অবোধ্য থেকে গেছে । এই যে বলেছে লোভ করোনা এর মানে কী ? যখন তিনি নিজেই প্রনাম আর প্রনামীর লোভে কাতর ! ভক্তদের দোহন করে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক ! নির্লোভ হয়ে কেন তিনি সব ত্যাগ দিচ্ছেন না !
তাই তারা যা বলে কেউ মানতে চায় না। আমিও মানতে পারলাম না- । তীব্র লোভ আমাকে আগাপাশতলা গিলে নিল। স্বাদু আর উৎকৃষ্ট খাদ্যের জন্য ছুটে ছুটে ওই রান্নার কাজে যেতে শুরু করলাম। মাস ছয়েক কাজ করার পর আমি রান্নাটা শিখে নিতে পারলাম। একটা দুটো জোগাড়ে নিয়ে দু তিনশো জনের রান্না করে ফেলতে পারতাম।
এই সময় একদিন উত্তর চব্বিশ পরগনার একটা অঞ্চল থেকে একটা অন্নপ্রাশনের কাজ এল । তিনশো জন লোকের খাওয়া দাওয়া। ভাত, বেগুন ভাজা, মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল, এচোঁড়ের একটা তরকারি, রুই মাছের কালিয়া, খাসির মাংস, আমের চাটনি , পাপড় ।
উত্তর চব্বিশ পরগনার এই গৃহকর্তার বড় মেয়ের বিবাহ হয়েছে কলকাতার যাদবপুরে। মেয়ের বউভাতে এসে নরেশ ঠাকুরের হাতের রান্না খেয়ে তিনি মোহিত হয়ে যান।আর সেই দিনই মনঃস্থির করে ফেলেন বড়ছেলের ঘরের নাতির অন্নপ্রাশনে এই কলকাতার ঠাকুরকে দিয়েই রান্না করাবেন। যখন সেই শুভদিন এল তারা কলকাতার ঠাকুরকে বায়না করে দিল নির্ধারিত দিনে রান্না করাবার জন্য।
কাজটা তো নরেশ ঠাকুর সেদিন ধরে নিয়েছিল কিন্ত তাঁর জানা ছিলনা যে ওই একই দিনে কলকাতায় আর একটা বড় কাজ এসে যাবে । আর সে কাজটা অন্য অপর কেউ নয়, যে মহাদেব ডেকরেটার্স থেকে সারাবছর কাজ পাওয়া যায় সেই মহাদেব সাহার মেয়ের বিয়ের কাজ। বলে দিয়েছেন মহাদেব বাবু- আমার বাড়ির কাজ কিন্ত তোমারই করা লাগবে । কোথায় তোমার কী আছে না আছে আমি জানতে চাইনা। কীভাবে ম্যানেজ করবে সে তুমি জানো। আমার বাড়ির কাজ তুমি নিজে না করলে তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ। আর আমার দোকান থেকে কোন কাজ পাবার আশা করো না।
এখন কী হবে ? উত্তর চব্বিশ পরগনার লোক বসে আছে নরেশের হাতের রান্না খাবার জন্য আর এদিকে মহাদেব সাহা দাঁড়িয়ে পড়েছে পথ রোধ করে। তখন বলে মেঘনাথ ওরফে মেঘা , মোনা আর দুইখ্যা রে ঠেইল্যা দাও। অরা ঠিক সামলাইয়া নিতে পারবে।
পারবি তো ? আমার আত্মবিশ্বাস তখন তুঙ্গে। নরেশ ঠাকুরের কথার জবাবে বলি- পারবো। বলে দেয় নরেশ ঠাকুর- গিয়ে পার্টিকে বলবি আমার শরীল হটাস করে খুব খারাপ হয়ে গিছে। তাই আমি যেতি পারলুমনি । কাজ শেষ করে আসার সময় মজুরির বাকি টাকা চেয়ে নিবি ।
আমরা দুজনে যাবো আজ বিকালে । গিয়ে উনুন বানাবো। রান্না করবোন কাল । ফিরতে পারবো তাঁর পরের দিন । মোট তিন দিনের মজুরি পাবো সেই আহ্লাদে মন নেচে ওঠে । অন্য কাজের মত রান্নার কাজ রোজ হয়না। মাসে দু চারদিন। একসাথে তিন দিন কাজ পেয়ে খুব খুশি আমাদের।
তখন সবে সূর্য পাটে বসেছে আমি আর দুঃখে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে গিয়ে পৌছালাম সেই বাড়িতে । চারদিকে কলাবাগান, পাটক্ষেত, ধানক্ষেত । দূরে দেখা যাচ্ছে সর্পিল রেল লাইন। সে সময় গোটা বাড়িটা সাজানোর কাজ চলছে। ডেকরেটর্সের লোকজন গেটের সামনে বাঁশের খুঁটি পুঁতছে। আগামীকাল এতে ফুল লতাপাতা দিয়ে সাজানো হবে। একজন লোক কুড়ুল দিয়ে একটা শুকনো গাছের চলা বানাচ্ছে। এই কাঠের চলায় কাল রান্না করা হবে। এখানে এখনো বিদ্যুৎ এসে পৌঁছাতে পারেনি। একজন কয়েকটা হ্যাজাকে কেরোসিন তেল ভরছে। বাড়ির লেপাপোছা উঠোনে এক আমগাছের নিচে ইজিচেয়ার পেতে বসে আছেন বাড়ির মহামহিম বড়কর্তা। লুঙ্গির মতো ভাঁজ করে তাঁর পরিধানে একটা ফিনফিনে ধুতি-। উর্ধাংগ অনাবৃত । গলায় ধব ধব করছে একটা পৈতা। তালপাতার পাখা দিয়ে তিনি হাওয়া খাচ্ছেন। তাঁর সামনে মাটিতে মাদুর বিছিয়ে শোয়ানো রয়েছে একটি নাদুস নুদুস ফরসা বাচ্চা। এরই কাল মুখে ভাত। শায়িত সে বাচ্চাটি যেন সোনা দিয়ে মোড়ানো । হাতে গলায় কোমড়- সবখানে কোন না কোন সোনার অলঙ্কার। এই সব শিশুরা সত্যিই বড় ভাগ্যবান । জন্ম মাত্র দশভরি সোনার মালিক। আমাদের দশ জন্মে যা হবার নয়। আমরা হাতা খুন্তি নিয়ে সেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই জিজ্ঞাসা করেন বড়কর্তা- নরেশ কোই ? সে আসে নাই? ক্যান ?
আমি বলতে চেষ্টা করি তাঁর শরীলটা ……। আমার কথা শেষ হবার আগেই বাঘের মত তিনি গর্জে উঠলেন- খুবোই খারাপ ! হটাৎ কইরা আইজ জ্বর আইসা গেছে। কী ! এই কবি তো ? খানিকক্ষণ আমাদের দিকে ক্ষুধার্ত বাঘের মত তাকিয়ে থেকে আবার বলে ওঠেন তিনি – তগো মইধ্যে ঠাহুর কেডা ? কেডা রান্না করবো ?
ভয়ে থতমত খেয়ে আমি ডানহাতের আঙ্গুল তুলে দুঃখেকে দেখাই, সে বাঁহাতের আঙ্গুল তুলে আমাকে দেখায়-। গর গর করে গৃহকর্তা আমাদের হুকুম করেন – ওই দিকে তাকা ! তাকাই সেই দিকে যেদিকে একজন মজুর কুড়ুল দিয়ে কাঠ চেড়াই করছে। উনি সেই চেলাকাঠ দেখিয়ে বলেন- কেডা রান্না করবি আমার দেখোনের কোন দরকার নাই। যদি রান্না খারাপ হয় ওই চেলা কাঠ তোগো পিঠে ভাঙ্গমু , এই কইয়া দিলাম । কথাডা মোনে থাকে য্যান।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলো । নিঃসীম ভয়ার্ত এক রাত ! আমাদের দুজনার কারো চোখে ঘুম নেই। রাতে আমাদের খেতে দিয়েছিল কিন্ত ভয়ে আমরা- জ্যান্ত পোনা মাছের ঝোল দিয়ে গরম ভাত- তৃপ্তি করে খেতে পারিনি । মন কুডাক ডাকছে –এ খাওয়াই শেষ খাওয়া হয়তো।
কাল যেখানে রান্না হবে সেখানে আমরা দুটো মাটির উনুন বানিয়েছি । শুয়ে আছি তাঁর পাশেই । এখানে মশা নেই তবু চোখে ঘুম আসছে না। আমার নিজের উপর আস্থা আছে । জানি আমি রান্না খারাপ করবো না। এমন কোন কিছু ঘটবে না যাতে পিঠে চেলাকাঠ পড়ে। কিন্ত দুঃখে আমার উপর কিছুতে সেই আস্থা বিশ্বাস রাখতে পারছে না। আমি তো আমি- অনেক বড় বড় রাঁধুনির এক একদিন রান্নার হাত খোলেনা। সেদিন শত চেষ্টার পরেও রান্না বিগড়ে যায়।
রাত খানিক গভীর হলে আমাকে ফিস ফিস করে ডাকে দুঃখে- এই মোনা- সব্বাই শুয়ে পড়েছে। চল এখোন আমরা পেলিয়ে যাই। এখন গেলি ভোরবেলার পেত্থম টেরেন ধরে নিতি পারবো। আন্না বান্নার কথা কিছু বলা যায়নে-। এই ভালো তো এই খারাব । এরা নোক ভালো নয় । যেদি আন্নায় কোন দোষ ঘাট হয় আর বাঁচাবে না । বড্ড ঠ্যাঙ্গাবে-।
দুঃখে যেটা বোঝেনা আমি বুঝি । আমরা এখন পালিয়ে চলে গেলে সকালে এরা খুব অসুবিধায় পড়ে যাবে। আমন্ত্রিত অতিথিদের খেতে দিতে সমস্যা হলে এরা আমাদের উপর আরো খেপে উঠবে । তখন খুঁজে গিয়ে যাদবপুরে ধরে বেদম মার মারবে। পাবলিক কেউ কিছু বলবে না । সবাই এদের সমর্থনই করবে। বলা যায় না কিছু না জানিয়ে আমরা চলে গেলে থানায় গিয়ে আমাদের নামে একটা চু্রির কেসও দিয়ে দিতে পারে । সে কথা বুঝিয়ে বলি দুঃখেকে- যা আছে ভাগ্যে তাই হবে । তুই ভালোমত আমারে জোগাল দিস, দেখিস আমি রান্না খারাপ করবো না। আগেও তো বার কয়েক দেখেছিস ! তাহলে ভয় পাচ্ছিস ক্যান !
দুঃখে সেদিন খুব ভালো জোগাল দিয়েছিল। আর আমি সেদিন রান্নাও ভালো করতে পেরেছিলাম। আগত অতিথি অভ্যাগতরা সে রান্না খেয়ে রান্নার প্রশংসাও করেছিল। এটা আমরা সবদিন করে থাকি। যখন সবাই খেতে বসে আমরা গিয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করি- রান্না কেমন হয়েছে? সবাই একবাক্যে বলেছিল- খুব ভালো হয়েছে।
সব ভালো সব সময় ভাল হয়না । এটা বুঝতে পারলাম শেষ ব্যাচের শেষ লোকটি খেয়ে উঠে যাবার পর। এই বাড়ির সেই যাদবপুরের জামাই সে কোনো সাধারন লোক নয়। অঞ্চল কাঁপানো এক মাস্তান। যার দুটো লরী আছে ! সে এতক্ষন প্রিয় শ্যালককে নিয়ে পাশের কলাবাগানের মাঁচার উপরে বসে পাঠার মেটুলি দিয়ে বাংলা মাল খাচ্ছিল । পান পর্ব সমাপন শেষে সে দুঃখেকে দেখে চিনে ফেলেছে– আরে, তুই আমাদের পাড়ায় সেদিন পানাপুকুর সাফ করতে এসেছিলি না ? রান্নার ঠাকুর বানিয়ে নরেশ বুঝি তোকে পাঠিয়েছে !
এটা সত্যি যে রান্নার কাজ সবদিন হবার নয়।প্রতিদিন বিয়ে অন্নপ্রাশন শ্রাদ্ধ হবেনা। মাসে দু তিন দিন মাত্র হতে পারে। কিন্ত পেটের খিদে তো সব দিনের ব্যাপার! বাধ্য হয়ে দুঃখে যখন যে কাজ পায় সেটাই করে থাকে। মাটি কাটা, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে, পানাপুকুর সাফ সাফাই। তা না করলে তো গরীব মানুষের সংসার অচল হয়ে যায় ! হতে পারে কোনও একদিন দুঃখে গিয়ে থাকবে জামাইবাবুর পাড়ায় পানাপুকুর সাফ করতে। সেদিন কোন কারনে তাকে দেখে মুখটা মনে করে রেখেছিল জামাই বাবু। যা আর ভোলেনি।
এবার সেই জামাইবাবু আর তার শ্যালক লোকচক্ষুর আড়ালে- কলাবাগানের অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে চেপে ধরলো আমাদের -। বল তোর কী নাম ? কী জাত ? সেই তীব্র জেরায় প্রকাশ হয়ে গেল আমি নমোশূদ্র আর দুঃখে কাওড়া । একজন পুর্ববঙ্গের আর একজন পশ্চিমবঙ্গের । দুজনেই জল অচল অচ্ছুত জাতির মানুষ !
সমাজে একদল মানুষ আছে যারা মানুষকে নিপীড়নের কোন সুযোগ পেয়ে গেলে আর ছাড়েনা। অসহায় দুর্বল প্রতিরোধে অক্ষম এদের সহজ শিকার । যাচ্ছিলো কোন কাজে পকেট্মার ধরা পড়েছে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো- হাত নিসনিপ করে উঠলো তাঁর দু ঘা দেবার জন্য। কেউ কারও দিকে আঙ্গুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলো- ছেলেধরা । কার ছেলে কে নিয়েছে দেখার আগেই ঝাঁপিয়ে গিয়ে দু-ঘা দিয়ে এলো। সেই মনোবৃত্তির মানুষ এরা- আমাদের পেয়ে যেন হাতে মহানন্দের একটি উপকরন পেয়ে গেলো। শুরু হলো আমাদের উপর অকথ্য অত্যাচার । নাকে খত দেওয়ানো, ধুতু ফেলে চাটানো, কান ধরে উঠ বস করানো, সাথে খানিক চড় চাপড় ! ঘন্টা দেড়েক ধরে এইসব করে শেষে হুকুম দিল- যা ভাগ ! এটা ওদের কাছে ছিল হয়তো একটা নিছক মজা কিন্ত আমাদের কাছে ছিল মৃত্যুতুল্য চরম অপমান।
সকাল প্রায় হয়ে গিয়েছিল । কাউকে কিছু না বলে, কাউকে কিছু বলার মতো, মুখ দেখাবার মতো মনের অবস্থা আমাদের আর না থাকায়- ভোরের আলো ফোটবার অনেক আগে আমরা দুই হতভাগা কোন পারিশ্রমিক না নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম সেই বাড়ি থেকে। রেললাইন ধরে হাটছিলাম রেলষ্টেশনের দিকে আর মরমে মরে যাচ্ছিলাম আমরা এমন এক ঘৃনীত জীবনের জন্য। আমাদের কোন গুন গুন নয়, মাত্র জন্মের কারনে বর্নবাদী সমাজের চোখে চোর পকেটমারের মতো হীন নীচ জীব । আমাদের উপর যার যা ইচ্ছা করে যেতে পারে তাতে তাদের কোন দোষ অপরাধ হবেনা।
এরপর আমি আর কোনদিন রান্নার কাজে যাইনি । অনেক সময় কেউ কেউ আমাকে পিকনিকে নিয়ে যেতে চেয়েছে। ‘তোর কোন টাকা পয়সা লাগবে না। খালি আমাদের রান্নাটা করবি’। তবু মুর্শিদাবাদ সুন্দরবন মাতলা দামোদরের চড়ে ভ্রমনে যেতে মনের সায় পাইনি । “অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস পায়” । রান্না না করতে করতে – আমি যে রান্না জানি সেটা প্রায় ভুলে যেতে বসে ছিলাম। আবার সেটা মনে করতে হলো অনেক বছর পরে।
বাইপাশের অদূরে মুকুন্দপুরে গড়ে উঠেছ্যে একটা মূক বধির স্কুল । স্কুল তো গড়ে তোলা হয়েছে কিন্ত তখনো সরকারী স্বীকৃতি বা কোন অনুদান আসেনি । এদিকে স্কুল খোলা মাত্র এসে গেছে ষাট সত্তর জন বাচ্চা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে । তাদের রাখতে হয়েছে অথচ খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা তেমন ভাবে করা যাচ্ছে না। কারন রান্নার কোন লোক পাওয়া যাচ্ছে না।
অঞ্চলটা খুব গরীব। এখানকার অধিকাংশ মানুষ খেটে খাওয়া জন মজুর । অনেকে রান্নার কাজ জানে সেই কাজ করেও। কিন্ত এখানে কেউ আসতে চাইছে না তার কারন- কাজ এখন করে যেতে হবে তবে মাইনে পত্র কিছু পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে সেদিন যেদিন সরকার স্বীকৃতি দেবে- অনুদান দেবে। কবে সেই স্বীকৃতি আসবে মাইনে আসবে তার কোন নিশ্চয়তা না থাকায় সাহস করে কোনো দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ কাজে আসতে উৎসাহ দেখাচ্ছিলো না। এটাও তাদের ভয়ের কারন ছিল- আমি বিনা মাইনেয় কাজ করলাম আর যখন সরকারী অনুদান আসবে আমাকে সরিয়ে ‘ওরা’ যদি তখন নিজের লোক ঢুকিয়ে নেয় ! এমনটা তারা করবে না তার কী গ্যারান্টি ? যারা হাজার হাজার অন্যায় করছে এটা করবে না সেটা কী করে বিশ্বাস করা যায় !
আমার তখন কোন কাজ ছিলো না। ‘আঙ্গন বাড়ির- ছাতুর ইস্কুলে’ চারশো টাকা মাইনেয় চাকরি করা বউয়ের পয়সায় বসে বসে খাচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম – আমি এই কাজটা নেবো। যখন চাকরি হবে- তখন হবে। আর যদি না হয় কমসে কম একটা খাওয়ার পেট তো কমে গেল। বউয়ের উপর থেকে চাপ খানিক তো কমে গেল। সে ভাবেই ওই মূক বধির ইস্কুলে চাকরিতে ঢুকে যাই।
আবাসিক স্কুল ! এখানে ভালো রান্না করার সুযোগ নেই। ভালো রান্না করতে হলে ভালো বাজার করা দরকার । ভালো জোগাড়ে থাকা দরকার। সে সব কিছু ছিলো না। বাজার থেকে শুকনো সিম পঁচা আলু পোকা বেগুন বুড়ো পুঁইশাক পাকা পটল পঁচা মাছ- যা সস্তায় পাওয়া যায় বস্তা ভরে এনে ওরা ঢেলে দিতো । আমরা তাকে খুটে বেছে কোনমতে মানুষের আহার যোগ্য বানাতাম। যেমন ভাল রান্না না করতে করতে আমার রান্নার হাত খারাপ হয়ে গিয়েছিল, ভালো রান্না না খেতে খেতে ওদের খারাপ হয়ে গিয়েছিল খাবার মুখ ।
আমার এখন একদিনের কথা মনে পড়ছে। সেদিন গুদামে ডাল ছিলোনা। রবিবার তাই বাজারও বন্ধ । এখন কী হবে ? তখন বলি হোষ্টেল ইনচার্জকে- আমি কিন্ত এমন ভাবে ভাতের ফ্যান রান্না করে দিতে পারি কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। ডাল ভেবে খাবে ।
পারবেন ? করুন তা হলে-!
একটু বেশি পরিমানে পেয়াজ ভেজে লাল করে তাঁর সঙ্গে খানিক রসুন কাচালংকা আদা টম্যাটো – আর সামান্য হলুদ তেজপাতা নুন মিষ্টি কালোজিরে ফোরন দিয়ে রান্না করেছিলাম ভাতের ফ্যান । কেউ কিছু বুঝতে যেমন পারেনি অনেকের মুখে এত স্বাদ লেগেছিল যে বাটি ভরে চুমুক মারছিল। বলতে গেলে এটাই আমার রাঁধুনি জীবনের শ্রেষ্ঠ রান্না। কয়েকজন কথা বলা লোকও হোষ্টেলে খায়- থাকে। তারা যখন বলছিল আজকের ডালটা অপুর্ব হয়েছে, ইচ্ছে হচ্ছিলো নিজেই চুমু মারি নিজের রান্না করা দুটো হাতে ।
এতক্ষন ধরে আপনারা আমার অখাদ্য লেখাটা পড়লেন আর মাত্র সামান্য কটা কথা লিখেই লেখা থামাবো। একটা রেসিপি বলে দিই । যে ভাবে আমি মাংস রান্না করে মহাশ্বেতা দেবীকে খাইয়ে খুব প্রসংশা পেয়েছিলাম- ।
মুরগির মাংস হাড় ছাড়া এক কিলো নেবেন । একশো গ্রাম টক দই । একশো গ্রাম কাজু বাদাম । পঞ্চাশ গ্রাম আদা। পঞ্চাশ গ্রাম রসুন । একশো গ্রাম খাটি ঘী। পোস্ত একশো গ্রাম। সাড়ে তিনশো সাদা তেল। আট দশটা মোটা কাচা লঙ্কা । সামান্য তেজ পাতা । আধ ফালি নারকেল কোরা । দশ গ্রাম এলাচ ।
প্রথমে হাড় ছাড়া মুরগির মাংস ছোট ছোট পিস করবেন সোয়াবিন আকারের । ভাল করে ধুয়ে জল ছেঁকে সামান্য নুন আদার রস রসুনবাটা কাচালঙ্কা বাটা মাখিয়ে আধঘন্টা রেখে দিন । নারকেল কোরা জলে ভিজিয়ে রাখুন । এলাচ গুড়ো করে রাখুন। আদা রসুন পোস্ত বেটে নিন। লংকার মাঝখান থেকে চিরে দিন। এরপর সাদাতেল কড়াইয়ে ছেড়ে গরম হয়ে গেলে মাংসগুলো অল্প অল্প করে মাছ ভাজার মতো ভেজে নিন।
এরপর সাদা তেলটার মধ্যে সামান্য ঘী ঢেলে দিন । সেই তেলে আদা বাটা রসুন বাটা আগে ঢেলে সামান্য ভেজে এরপর পোস্ত বাটা দিয়ে অল্প করে ভাজুন । তারপর নারকেল গুলো ছেকে শুধু দুধটা মশলায় ফেলে ভাজুন । এরপর দিন টক দইটা । এবার ভাজা মাংসগুলো ওর মধ্যে ঢেলে তেজপাতা পরিমান মত নুন দিন কাঁচা লংকা দিন। ওভেনের আগুন কমিয়ে দিয়ে অনবরত নাড়তে থাকুন। বেশ কিছু সময় ভাজার পর মাংস সেদ্ধ হয়ে গেলে ঘীটা দিয়ে দিন , অতি সামান্য চিনি , দেবেন পেশাই করা এলাচ গুড়ো। ভুলেও কিন্ত হলুদ দেবেন না। মাংস হবে একেবারে সাদা। যখন দেখবেন পুরো সেদ্ধ হয়ে গেছে ওভেন নিভিয়ে কয়েক মিনিট রেখে দিন। এরপর ভাত রুটি যার সঙ্গে ইচ্ছা খেয়ে দেখুন। ভালো হলে জানবেন- আমার গুন । খারাপ হলে ওটা আপনার রান্নার দোষ।
*****
আপনাকে কখনো সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয়নি, আপনার লেখা পড়ে তা সম্ভবপর হয়েছে। এই লেখাটি পড়ে মনে হয়েছে যেন আপনি আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া মানুষদের একজন প্রতিনিধি – আপনার এবং দুঃখের ওপর দিয়ে সেদিন যা কিছু গেছে তা অনুভব করতে পারি। সংগ্রাম করে বেঁচে থাকাই যে জীবনের মূলমন্ত্র সেটা আপনার লেখার মধ্যে দিয়ে বারবার ফুতে উথেছে – এই লেখাতেও তার অন্যথা হয়নি।
– সুদীপ্ত কুমার পাল, ধুপগুড়ি, জেলা-জলপাইগুড়ি